দিলারা জামান, দেশের মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের বর্ষীয়ান এক অভিনেত্রী। একুশে পদক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত বরেণ্য এই অভিনেত্রী আজ পা রাখলেন জীবনের ৮১তম বছরে। তবে গত কয়েক বছরের মতো এবারও নিজের জন্মদিনে বিশেষ কোনো আয়োজন রাখেননি তিনি। দিলারা জামান বলেন, ‘কখন ঘটা করে জন্মদিন পালনের পক্ষে নই আমি। এই বয়সেও সুস্থ আছি, দীর্ঘ এই পথ চলার দর্শক ও সহকর্মীদের ভালোবাসা পাচ্ছি, এটাই বড় প্রাপ্তি। এজন্য সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’
জীবন অধ্যায়ের ৮০ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো রকম ক্লান্তি স্পর্শ করেনি খ্যাতিমান এই তারকাকে। আগের মতোই এখনো অভিনয় করে যাচ্ছেন।
অভিনয়ই যেন তার হৃদয় স্পন্দন। শান্তির আসল ঠিকানা। তিনি বলেন, ‘অভিনয় আমার কাছে ভীষণ ভালোবাসার জায়গা। শুটিংয়ে গেলে মনে হয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আছি। তাদের সান্নিধ্য আমাকে ভালো রাখে। এজন্য এখনো এ বয়সে এসেও অভিনয় আমাকে টানে। অভিনয় করতে চাই আরও। তবে, সবার কাছে দোয়া চাই, যেন সুস্থ থাকতে পারি।’
দিলারা জামান ১৯৪৩ সালের ১৯ জুন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ) বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রফিকউদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম সিতারা বেগম।
ডাকনাম লিলি থাকলেও কাগুজে নাম দিলারা জামান। তার জন্মের কিছুদিন পর তার পরিবার আসানসোল জেলায় চলে যান। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তারা যশোর জেলায় চলে আসেন। দিলারা ঢাকার বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। স্কুলে পড়ার সময়ই মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন। পরে তিনি ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন। তার কর্মজীবন শুরু হয় রাজধানীর শাহীন স্কুলের শিক্ষকতা দিয়ে। ১৯৬৬ সালে ‘ত্রিধরা’ শিরোনামে একটি একক নাটকের মাধ্যমে ছোটপর্দায় অভিষেক ঘুচে তার। এই অভিনেত্রীর প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘সকাল সন্ধ্যা’। ১৯৯৩ সালে তিনি মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘চাকা’তে অভিনয় করেন। প্রথম পূর্ণদের্ঘ্য চলচ্চিত্র হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’।
২০০৮ সালে তিনি মুরাদ পারভেজ পরিচালিত ‘চন্দ্রগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে ময়রা মাসি চরিত্রে অভিনয় করে সহশিল্পী চম্পার সঙ্গে যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ‘আগুনের পরশমণি’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘মনপুরা’, ‘চন্দ্রগ্রহণ’, ‘অপেক্ষা’, ‘আলতাবানু’, ‘পোস্টমাস্টার ৭১’ , ‘মিশন এক্সট্রিম’, ‘চিরঞ্জীব মুজিব’, ‘গোর’সহ অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সুনাম ছড়িয়েছেন। কিছুদিন আগেও দিলারা জামান অভিনীত একটি সিনেমা মুক্তি পায়। সিনেমাটিতে তার অভিনয় দর্শকের কাছে দারুণ সমাদৃত হয়েছে। দিলারা জামান অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ছিল (স্বল্পদৈর্ঘ্য) এম এম রহিমের ‘ওমর ফারুকের মা’। এতে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিলারা জামান।
দিলারা জামান বলেন, ‘দর্শকের ভালোবাসা নিয়ে এখনো মন থেকে অভিনয় করে যাচ্ছি। প্রতিনিয়তই চলার পথে মানুষের যে ভালোবাসা পাই, তাই আমাকে ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত করে। মানুষের এই যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা তা অভিনয় না করলে হয়তো পাওয়া হতো না।’ দিলারা জামান জানান, মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে তার আফজাল হোসেন পরিচালিত ‘মানিকের লাল কাঁকড়া’, চয়নিকা চৌধুরীর ‘প্রহেলিকা’, শ্যাম বেনেগালের বায়োপিক ‘মুজিব’, জেড এইচ মিন্টুর ‘ক্ষমা নেই’, জাহিদ হোসেনের ‘সুবর্ণ ভূমি’সহ আরও বেশ কয়েকটি সিনেমা।
দিলারা জামান ফখরুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই কন্যা, তানিয়া চিকিৎসক এবং যুবায়রা আইনজীবী। সেকাল ও একালের ব্যবধান প্রসঙ্গে দিলারা জামান বলেন, ‘অনেক কিছু বদলে গেছে। প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। পুরো পৃথিবীই এখন হাতের মুঠোয়। সবকিছু ঘরে বসে দেখা যায়। অভিনয়ের ধরন বদলে গেছে। আগের নাটকের সঙ্গে তুলনা করলে এখন হবে না। তখন একটি মাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল। একটি চ্যানেলই দেখতে বাধ্য ছিল সবাই। এখন তো আর তা নয়। তবে শুধু সেকালে ভালো কাজ হতো, একালে ভালো কাজ হয় না, এটা সত্য না। এখনো ভালো কাজ হচ্ছে। এক ঈদে ৩০০ থেকে ৪০০ নাটক প্রচার হয়। একজন দর্শক কয়টা নাটক দেখতে পারেন? অথচ সেকালে একটি নাটকই সবাইকে দেখতে হতো। আমি বলব একালে ভালো কাজ হচ্ছে, জীবন ঘনিষ্ঠ অনেক কাজ হচ্ছে।