আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস মিলে বর্ষকাল। বর্ষা বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতির জন্য এক অপরিহার্য ঋতু। বর্ষা মানেই মেঘ, বৃষ্টি, নতুন প্রাণ ও জেগে ওঠার অনুষঙ্গ। বর্ষা আবহমান বাংলাকে রূপবতী করে তোলে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা গরমের পর বর্ষা যেন বহুল প্রতীক্ষিত এক ঋতু। সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিয়ে থাকা রাশি রাশি কদম ফুলের কলি যেমন আষাঢ়ের বাদলা দিনের অপেক্ষায় থাকে, তেমনি অপেক্ষায় থাকে বর্ষার বৃষ্টি।

বর্ষায় বিলে-ঝিলে শাপলা-শালুক ফোটে। কদমের পাশাপাশি হিজল-কেয়ার অপরূপ রূপে সেজে ওঠে চারপাশ। রিমঝিম বৃষ্টির শিহরণ হৃদয়কে করে তোলে স্নিগ্ধ ও সুশোভিত। বৃষ্টির পরশে নতুন শস্যাদি জন্মায়। জমি উর্বর হয়। নদী, খাল-বিল ফিরে পায় তার যৌবন। গাছপালা ফিরে পায় সবুজ প্রাণ।

এ সময়ে আউশ ধানের ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য যত্ন নিতে হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগ ও পোকামাকড় দমন করতে হবে। বন্যার আশঙ্কা হলে আগাম রোপণ করা আউশ ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলেই প্রয়োজনে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করে কেটে মাড়াই-ঝাড়াই করে শুকিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

আমন ধানের বীজতলা তৈরির সময় এখন। পানিতে ডুবে না এমন উঁচু খোলা জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বন্যার কারণে রোপা আমনের বীজতলা করার মতো জায়গা না থাকলে ভাসমান বীজতলা বা দাপগ পদ্ধতিতে বীজতলা করে চারা উৎপাদন করা যায়। বীজতলায় বীজবপন করার আগে ভালো জাতের মানসম্পন্ন বীজ নির্বাচন করতে হবে।

আষাঢ় মাসে রোপা আমন ধানের চারা রোপণ শুরু করা যায়। মূল জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টর প্রতি ৯০ কেজি টিএসপি, ৭০ কেজি এমওপি, ১১ কেজি দস্তা এবং ৬০ কেজি জিপসাম দেওয়া প্রয়োজন; জমির এক কোণে মিনিপুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন- যেন পরবর্তী সময়ে সম্পূরক সেচ নিশ্চিত করা যায়।

পরিপক্ব হওয়ার পর বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ার আগে মোচা সংগ্রহ করে ঘরের বারান্দায় রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে মোচা থেকে দানা সংগ্রহ করতে প্রয়োজনে ভুট্টা মারাই যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। রোদ হলে শুকিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মোচা পাকতে দেরি হলে মোচার আগা চাপ দিয়ে নিম্নমুখী করে দিতে হবে, এতে বৃষ্টিতে মোচা নষ্ট হবে না।

পাট গাছের বয়স চারমাস হলে ক্ষেতের গাছ কেটে নিতে হবে। পাট গাছ কাটার পর চিকন ও মোটা গাছ আলাদা করে আঁটি বেঁধে দুই-তিন দিন দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। পাতা ঝরে গেলে ৩ থেকে ৪ দিন পাট গাছগুলোর গোড়া একফুট পানিতে ডুবিয়ে রাখার পর পরিষ্কার পানিতে জাগ দিতে হবে।

পাট পচে গেলে পানিতে আঁটি ভাসিয়ে আঁশ ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে পাটের আঁশের গুণাগুণ ভালো থাকবে। ছাড়ানো আঁশ পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে বাঁশের আড়ে শুকাতে হবে। যেসব জায়গায় জাগ দেওয়ার পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচাতে পারেন। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং পচন সময় কমে যায়। পাট পচনে পানির ঘাটতি সমাধানে মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।

এ সময়ে উৎপাদিত শাকসবজির মধ্যে আছে ডাঁটা, গিমাকলমি, পুঁইশাক, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, ঝিঙা, শসা, ঢঁ্যাড়স, বেগুন। এসব সবজির গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনে মাটি তুলে দিতে হবে। এ ছাড়া বন্যার পানি সহনশীল লতিরাজ কচুর আবাদ করতে পারেন; উপকূলীয় অঞ্চলে ঘেরের পাড়ে গিমাকলমি ও অন্যান্য ফসল আবাদ করতে পারেন; সবজি ক্ষেতে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। পানি জমে গেলে সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে; তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরার জন্য বেশি বৃদ্ধিসমৃদ্ধ লতাজাতীয় গাছের ১৫-২০ শতাংশের লতাপাতা কেটে দিতে হবে। কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা হাত পরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।

মুখী কচু জমিতে লাগানো শেষ হয়েছে। মুখী কচুর পুরো উৎপাদন মৌসুমে ৪-৬ বার আগাছা দমনের প্রয়োজন হয়। অঙ্কুরোদগম পূর্ব অনুমোদিত মাত্রায় আগাছানাশক বীজ বপনের পরপর স্প্রে করার দুই মাস পর থেকে এক মাস অন্তর অন্তর চারবার নিড়ানি দ্বারা আগাছা দমন করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সারের উপরিপ্রয়োগের আগে আগাছা দমন আবশ্যক।

আগাম জাতের শিম এবং লাউয়ের জন্য প্রায় ৩ ফুট দূরে দূরে ১ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে। মাদা তৈরির সময় গর্তপ্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম সরিষার খৈল, ২ কেজি ছাই, ১০০ গ্রাম টিএসপি ভালোভাবে মাদার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর প্রতি মাদায় ৩ থেকে ৪টি ভালো সবল বীজ রোপণ করতে হবে। এ ছাড়াও আগাম শীতকালীন সবজি উৎপাদনে টানেল টেকনোলজি ব্যবহার করা যেতে পারে।

এ সময়টা গাছের চারা রোপণের জন্য খুবই উপযুক্ত। বসতবাড়ির আশপাশে, খোলা জায়গায়, চাষাবাদের অনুপযোগী পতিত জমিতে, রাস্তাঘাটের পাশে, পুকুর পাড়ে, নদীর তীরে গাছের চারা বা কলম রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে; এ সময় বনজ গাছের চারা ছাড়াও ফল ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করতে পারেন; ফলের চারা রোপণের আগে গর্ত তৈরি করতে হবে; সাধারণ হিসাব অনুযায়ী এক ফুট চওড়া ও এক ফুট গভীর গর্ত করে গর্তের মাটির সঙ্গে ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমওপি সার মিশিয়ে, দিন দশের পরে চারা বা কলম লাগাতে হবে। বৃক্ষ রোপণের ক্ষেত্রে উন্নত জাতের রোগমুক্ত সুস্থ ও সবল চারা বা কলম রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর শক্ত খুঁটি দিয়ে চারা বেঁধে দিতে হবে। এরপর বেড়া বা খাঁচা দিয়ে চারা রক্ষা করা, গোড়ায় মাটি দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার, সেচ ও নিকাশ নিশ্চিত করতে হবে; নার্সারি মালিক যারা তাদের মাতৃগাছ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুব জরুরি। সার প্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, দুর্বল রোগাক্রান্ত ডালপালা কাটা বা ছেঁটে দেওয়ার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে হবে।