০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আমদানিতে ডলারের দাম ছিল ১০৬ টাকা। আগস্টে এসে ব্যাংকগুলো ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দামে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করছে। তবে ডলার সংকটের কারণে ১১৬ টাকার চেয়ে বেশি দামে অনেক ব্যাংক আমদানির ঋণপত্র খুলছে। ফলে খাদ্য এবং শিল্প-কারখানার কাঁচামালসহ সব ধরনের পণ্যের আমদানি খরচ বেশখানিকটা বেড়েছে। আর উচ্চমূল্যে আমদানির এই ধাক্কা দেশীয় পণ্যে পড়েছে। এছাড়া ডলার সংকট ও এলসি খোলার সমস্যায় আমদানি কমে যাওয়ার দেশীয় পণ্যের দাম আরও এক ধাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত এক বছরে প্রতি ডলারের জন্য আমদানি ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ১৬ টাকা। গত বছরের ৭ জুন প্রতি ডলারের জন্য ব্যবসায়ীদের যেখানে ব্যয় করতে হয়েছিল ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা, সেখানে চলতি বছরের ৭ জুনে তা বেড়ে হয়েছে ১০৮ টাকা ৪৫ পয়সা। এ হিসেবে শুধু ডলারের বিপরীতে ব্যবসায়ীদের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মূল্যের এ তথ্য বাজারের অবস্থার সঙ্গে কোনো মিল নেই। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো ডলারের দাম নিচ্ছে। লুটের মালের মতো ব্যাংকগুলো যেভাবে পারছে সেভাবে ডলারের দাম নিচ্ছে। বর্তমানে এক ডলারের বিপরীতে ১১৬ টাকা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের হিসাবে আগের চেয়ে তাদের আমদানি ব্যয় ২০ থেকে ২২ শতাংশ বেড়েছে। বাড়তি এই খরচ তাদের পণ্যের প্রকৃত মূল্যের সঙ্গে যুক্ত করতে হচ্ছে। এছাড়া একই মূলধনে আগের চেয়ে কম পণ্য আমদানি করতে পারায় এর একটি বড় প্রভাব আমদানিকৃত পণ্যের ওপর পড়েছে।
এদিকে, আমদানি খরচ আরও বেড়ে দেশীয় পণ্যের দামের ওপর এর চাপ আরও বাড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদ ও বাজার পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন। তাদের ধারণা, দেশে ডলারের সংকট সহসাই কাটছে না। ফলে ডলার, পণ্য ও জ্বালানিসহ অন্যান্য সেবার মূল্যবৃদ্ধির চাপ বছরজুড়েই মোকাবিলা করতে হবে। এর প্রভাবে আমদানি পণ্যের দাম আরও বাড়বে। ফলে দেশীয় পণ্যের দামেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে বিনিয়োগ খুব একটা বাড়বে না। এতে কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হবে। আগের কর্মসংস্থান ধরে রাখাও হবে চ্যালেঞ্জিং। ডলারের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবগুলো আরও বেশি ভোগাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম হু-হু করে বেড়ে যায়। ওই সময় থেকেই দেশে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বেড়ে যায় জ্বালানি তেলসহ প্রায় সব পণ্যের দাম। বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতির হার। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বছরের এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে ২৫ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ করে। পরে ধাপে ধাপে তা বাড়িয়ে শতভাগ করা হয়। কেবল খাদ্য, জ্বালানি, কৃষি, শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আমদানি ছাড়া বাকি সব পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের সংস্থান ছাড়া কোনো এলসি খোলা যাচ্ছে না। ফলে এখন কেবল যাদের ডলার আয় আছে যেমন- রপ্তানিকারক, কেবল তারাই এলসি খুলতে পারছেন। এর বাইরে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের কিছু বাড়তি ডলার দিয়ে সরকারি খাত এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। এছাড়া বাণিজ্যিক খাতে কোনো পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি খাতনির্ভর যেসব শিল্প দেশে গড়ে উঠেছিল সেগুলো এখন গভীর সংকটে নিমজ্জিত। এর মধ্যে রড তৈরির কাঁচামাল ক্র্যাপ ভেসেল বা পুরনো জাহাজ ৬১ শতাংশ, আয়রন ও স্টিল ক্র্যাপ ২০ শতাংশ, বিভিন্ন ধরনের মেটাল ৭১ শতাংশ, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল ১৪ শতাংশ, কটন ইয়ার্ন ৪০ শতাংশ আমদানি কমেছে। এমনকি রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও ১৬ শতাংশ কমেছে, এলসি খোলা কমেছে ৩৪ শতাংশ। বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানির আদেশ কম আসায় এ খাতে এলসি ও আমদানি কমেছে। এসব খাতে কর্মসংস্থান যেমন কমেছে, তেমনি জিডিপিতে অর্থের জোগানও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ডলার সংকটে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ভোগ্যপণ্যের আমদানি ১২ শতাংশ ও এলসি খোলা কমেছে ১৮ শতাংশ।
শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালের এলসি ৩১ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ২৪ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি ৩২ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ১০ শতাংশ। শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি ৫৭ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ১৭ শতাংশ। বিবিধ শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি কমেছে ৪৬ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ৩২ শতাংশ। অন্যান্য পণ্যের এলসি ২০ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ১ শতাংশের বেশি। এর প্রভাবে শিল্প খাতে নেতিবাচক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। উৎপাদন কমছে। এতে দেশে উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে বাড়তি খরচ যোগ করে বাজারজাত ও বিপণন করতে হচ্ছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কাক্সিক্ষত হারে রপ্তানি আয় বাড়ছে না। উপরন্তু মুনাফার হার কমিয়ে দিয়ে বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেও চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) নির্দেশনা না মেনে অনেক ব্যাংক বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। যেহেতু বেশি মূল্যে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে এ কারণে আমদানিকারকদের কাছ থেকেও বেশি মূল্য আদায় করছে। এর ফলে পণ্যের আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। আর পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অর্থই হলো মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া।
তবে দেশীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতির জন্য আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি প্রধান কারণ হলেও এর সঙ্গে সিন্ডিকেটের কারসাজির বড় প্রভাব রয়েছে বলে বাজার পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। তারা বলছেন, পণ্য আমদানি কমা ও উচ্চমূল্যে আমদানির কারণে স্বাভাবিকভাবে যতটুকু সংকট তৈরি হয়েছে, এর চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে পণ্য মূল্যস্ফীতি। আমদানি সংকটের অজুহাতে অনৈতিকভাবে পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রবণতা রয়েছে ব্যবসায়ীদের। এছাড়া আছে সিন্ডিকেটের প্রভাব।
বাজারের তথ্য বলছে, আমদানি সংকটে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে খাদ্যপণ্যের। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক বছরের ব্যবধানে আমদানিনির্ভর চিনির দাম বেড়েছে ৫১ শতাংশ। এ সময় ৮৫ থেকে ৯০ টাকার চিনি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। এছাড়া বাজারে গুঁড়া দুধের দাম ১৭ শতাংশ, ধনে, জিরা, লবঙ্গের মতো গরম মসলার দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া আদা-রসুনের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। আদার দাম বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩শ’ শতাংশ এবং রসুনের দাম ৮৭ শতাংশ বেশি। একশ’ টাকার মধ্যে বিক্রি হওয়া এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এখন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিতে ঠেকেছে। আমদানিকৃত এসব পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে উৎপাদিত পণ্যেরও একই হারে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে।
অন্যদিকে কাঁচামাল আমদানি কম হওয়ায় বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ছিল রড ও ইস্পাত পণ্যের। তথ্য বলছে, গত এক বছরে প্রতি টন রডের দাম প্রায় ২৫ হাজার পর্যন্ত বেড়ে লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। একই অবস্থা লেখার কাগজের ক্ষেত্রেও। গত এক বছরে লেখার কাগজের দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। এছাড়া গত এক বছরে প্রাণী খাদ্যশিল্পের কাঁচামাল, খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের কাঁচামাল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল, প্লাস্টিক পণ্য ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা আমদানি সংকটের কথা জানিয়েছেন।
তাদের ভাষ্য, এ বছর খাদ্যশস্য আমদানি অনেক কমেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কাঁচামালের অভাবে পণ্য উৎপাদন কমিয়েছে। আবার বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বমুখী দামের একটা প্রভাব রয়েছে। এসব কারণে পণ্য সরবরাহে ব্যাঘাত হওয়ায় দাম বেড়েছে, যা সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছরের শুরু থেকেই পণ্য আমদানি করতে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে ডলার। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে তারা এমন সংকটের মুখে পড়েনি। এলসি করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পণ্য দেশে আনার পরও সমস্যা হচ্ছে। ডলার না থাকায় দিনের পর দিন পণ্য সাগরে ভাসছে। এতে আমদানিকারকদের খরচ বাড়ছে। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে।
তবে এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের স্বাভাবিক সময়ের মতো আমদানি করার সামর্থ্য নেই এটা সত্য। সার্বিক রিজার্ভ কমেছে এ সময়, অনেক পাওনা রয়েছে যেগুলো অপরিশোধিত। সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে পণ্য আমদানি সাশ্রয় হ্রাস একটি বড় কৌশল। তিনি বলেন, তবে আমদানি কমে যাওয়া খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি আমদানি কমায় ভোক্তারা পণ্যের দামের চাপে পড়ছে। আবার যতটুকু মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হয়েছে, এর চেয়ে বেশি বাজারে সিন্ডিকেট করে অনৈতিক সুবিধা নেওয়া হচ্ছে। যতটুকু প্রকৃত চাপ রয়েছে, তার চেয়ে বাড়তি চাপ দেখানো হচ্ছে।