গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার ও দুর্নীতি বন্ধের যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, সাম্প্রতিক সময়ে তা বাস্তবায়নে চরম ব্যর্থতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুলিশ বিভাগের ঘুস, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা এখনও অব্যাহত। যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক অসন্তোষ। দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যরা সেই আগের মতই চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের অপরাধকর্ম। একইসঙ্গে বন্ধ হয়নি তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার।

অভিযোগ উঠেছে, ট্রাফিক পুলিশের ঘুস গ্রহণ থেকে শুরু করে থানায় সাধারণ ডায়েরি বা মামলা করতে গেলেও নেওয়া হয় ঘুস। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া ও ভুক্তভোগীদের হয়রানি করার অভিযোগ এখনও বিরাজমান। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের প্রতি আস্থা ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্যগুলি এখনো পূরণ হয়নি। অপরাধ দমন করার বদলে পুলিশের কিছু অংশ অপরাধকে প্রতিনিয়ত মদদ দিচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, পুলিশের সংস্কারের জন্য আরো স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ নজরদারি ও স্বাধীন তদন্ত ব্যবস্থার প্রয়োজন। অন্যথায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের অবিশ্বাস আরো বাড়বে। যা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। তারা এটাও মনে করেন, পুলিশ বিভাগের সংস্কার এবং দুর্নীতি রোধে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে গণঅভ্যুত্থানের অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যেতে পারে। আর এখনই সময় নতুন উদ্যোগ ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার। যাতে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

এদিকে পুলিশের অনেক সদস্য এখনো থানায় ঘুস খাচ্ছে এমন অভিযোগ এনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম। গত শনিবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ অভিযোগ করেন। সারজিস তার পোস্টে বলেন, ‘শত শত পুলিশ এখনো থানায় টাকা খাচ্ছে। যেসব বেহায়ার রক্তে দুর্নীতি তাদের শাস্তি না দিয়ে কী করে সংস্কার করবেন? শুধু বদলি করে? হাস্যকর…’

অন্যদিকে এসব অনিয়ম ঠেকাতে ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এ তদন্ত থেকে পুলিশকে সরানোর চিন্তা করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফৌজদারি মামলা তদন্তে আলাদা তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। প্রস্তাব অনুযায়ী, পুলিশের বদলে মামলার তদন্ত করবেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা। তদন্তকাজ তদারক করবেন সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি বা প্রসিকিউটর। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, তদন্ত সংস্থায় নিয়োজিত জনবল পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। সংস্কার কমিশনের সূত্র বলছে, তদন্তের ক্ষমতা পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে পৃথক তদন্ত সংস্থাকে দিলে তদন্ত দ্রুত ও স্বচ্ছ হবে। এতে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কমবে, প্রকৃত আসামিদের সাজা হবে, নির্দোষ মানুষ ফাঁসবে না এবং তদন্তে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত হবে।

সূত্র বলছে, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনরা সংবাদ সম্মেলনসহ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন।

এছাড়া ঢাকার মিরপুর এলাকায় একটি জমি দখল নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় এক ভুক্তভোগী থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ কর্মকর্তা মামলা নেওয়ার আগে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। ভুক্তভোগী টাকা দিতে অপারগ হলে, তার অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের একটি দল যানবাহন চেকিংয়ের নামে চালকদের কাছ থেকে নিয়মিত ঘুষ নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি গোপন ভিডিওতে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ এক চালকের কাছ থেকে লাইসেন্স প্রদর্শনের পরও ৫০০ টাকা দাবি করছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

নারায়ণগঞ্জে এক ধর্ষণ মামলার প্রধান অভিযুক্তের পরিবার পুলিশের কাছে ২ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে তাকে মুক্ত করার অভিযোগ তোলেন স্থানীয়রা। ভুক্তভোগী পরিবার থানার সামনে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানালে বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরবর্তীতে অভিযুক্তকে আটক করা হলেও ঘুষ নেওয়ার দায়ে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গত ২৩ ডিসেম্বর বরিশালে চাঁদাবাজির সময় পুলিশের এক উপপরিদর্শককে আটক করে সাধারণ জনতা। অভিযুক্ত ওই পুলিশ সদস্যের নাম রেদোয়ান। বরিশাল নগর পুলিশের বিমানবন্দর থানার ওসি জাকির হোসেন শিকদার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ওই মামলায় রেদোয়ানসহ দুজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এদিকে রাজশাহী জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এক উপপরিদর্শকের (এসআই) বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে রাজশাহী প্রেসক্লাবে মুরাদ হোসেন নামের এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী সংবাদ সম্মেলন করেন। ওই এসআইয়ের নাম আবদুর রহিম। সংবাদ সম্মেলনে মুরাদ বলেন, তুলে নেওয়ার পর মাদক মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে এসআই রহিম তাঁর কাছ থেকে ২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা আদায় করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়। এ বিষয়ে রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) ফারজানা ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষ তো মামুলি ব্যাপার। খোদ নিজ বাহিনীর সদস্যকেও ছাড় দিচ্ছে না পুলিশ। অভিযোগ আছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই রামপুরায় পুলিশের উপ-পরিদর্শক অনুপ বিশ্বাস ইটের আঘাতে মাথায় আহত হয়ে প্রায় দুই সপ্তাহ হাসপাতালে ছিলেন। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের দেড় মাস পর তিনি জানতে পারেন যে, ১৯ জুলাই খিলগাঁওয়ে বিক্ষোভে একজন আহত হওয়ার ঘটনায় তাকে ১৭ অক্টোবর দায়ের হওয়া হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছে, যদিও তখন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এক সহকর্মী পরে জানান, তাকে এক লাখ টাকা ঘুস দিতে হবে। টাকা না দিলে তাকে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে। অনুপ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। এ কারণে ঘুস না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অনুপ বলেন, ‘আমি যখন হাসপাতালে মৃত্যুর লড়ছি, তখন জানতে পারি আমাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় আসামি করা হয়েছে। যখন আমি হাসপাতালের বিছানায় অজ্ঞান তখন কিভাবে এই অপরাধ করলাম?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি। অনুপ বলেছেন, টাকা দিতে অস্বীকার করার পরে তাকে একাধিক হত্যা মামলায় আসামি করার হুমকি দেওয়া হয়। ওই মামলায় অভিযুক্ত কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার অভিযোগ, তাদের কিছু সহকর্মী স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে মিলে একটি চাঁদাবাজ চক্র তৈরি করেছেন। সহজে ফাঁসানো যাবে পুলিশের এমন সদস্যদের টার্গেট করছেন তারা।

এসব বিষয়ে জানতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।