বিশ্বজুড়েই ক্যানসার আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। তবে সে তুলনায় এ রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনে প্রত্যাশিত অগ্রগতি নেই এখনো। নানা সময়ে ক্যানসারের চিকিৎসা বা ওষুধ উদ্ভাবনের খবর নজরে এলেও সেগুলো এখনো স্বীকৃত বা যথেষ্ট কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনো এ মরণব্যাধি থেকে রোগীদের বাঁচানোর সুনির্দিষ্ট ও নিরাময়যোগ্য উপায় বের করতে পারেনি।
বাংলাদেশে ক্যানসার রোগের চিকিৎসায় এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। দেশে বর্তমানে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত এর সঠিক তথ্য পেতেও হিমশিম খেতে হয়। এর মূল কারণ, দেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৫৬ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। বছরে ক্যানসারে মারা যাচ্ছেন এক লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জন। মৃত্যুর সংখ্যাও পুরুষ বেশি। সংস্থাটি বলছে, মৃত রোগীদের হিসাব বাদ দিলে বাংলাদেশে এখন ক্যানসার আক্রান্ত রোগী রয়েছেন তিন লাখ ৪৬ হাজারের কিছু বেশি।-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
এছাড়া বাংলাদেশে ক্যানসারের যেটুকু চিকিৎসা সুবিধা তা এখনো শুধুই ঢাকাকেন্দ্রিক। যদিও সারাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তবে সেসব হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা না পাওয়ায় রোগীরা ছোটেন ঢাকায়। আবার ঢাকায় যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে হন বিদেশমুখী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৫৬ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। বছরে ক্যানসারে মারা যাচ্ছেন এক লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জন। মৃত্যুর সংখ্যাও পুরুষ বেশি। সংস্থাটি বলছে, মৃত রোগীদের হিসাব বাদ দিলে বাংলাদেশে এখন ক্যানসার আক্রান্ত রোগী রয়েছেন তিন লাখ ৪৬ হাজারের কিছু বেশি।
দেশে ক্যানসারের চিকিৎসায় ভোগান্তি, খরচে নিঃস্ব মানুষ
সরকারি রেডিওথেরাপির বেশিরভাগই অকেজো
বিভিন্ন দেশ ও ক্যানসারের নানা ধরনের ওপর এক গবেষণা প্রতিবেদনে সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা ২০২২ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। বাংলাদেশে সাধারণত খাদ্যনালি, ঠোঁট, ওরাল ক্যাভিটি এবং ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। এছাড়া তামাক, অ্যালকোহল, স্থূলতা এবং বায়ুদূষণকে বিশ্বব্যাপী ক্যানসার আক্রান্ত রোগী বাড়ার কারণ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। এছাড়া বংশগত বা পরিবেশগত কারণেও ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের প্রকোপ বেশি এবং নারীদের মধ্যে স্তন ও জরায়ুর ক্যানসার সবচেয়ে বেশি। তারা মনে করেন, দেরিতে ক্যানসার শনাক্ত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। ভেজাল খাবার ও জাংক ফুডের ব্যবহার, অলস জীবনযাপন, দূষণ এবং তামাক ও অ্যালকোহল ব্যবহার বাংলাদেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগী বাড়ার অন্যতম কারণ
মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটের চারতলার পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা দীপু। বয়স ২০ বছর। গত এক বছর ধরে তিনি ক্যানসারে ভুগছেন। তার মা মাহফুজা এক বছর ধরেই ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটছেন।
মাহফুজা জাগো নিউজকে বলেন, ছেলের চিকিৎসা চলছে। পিঠে টিউমার হয়েছিল, সেখান থেকে ক্যানসার হয়েছে। প্রতি ১৫ দিন পর পর হাসপাতালে আসি। কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ক্যানসার আরও ছড়িয়ে গেছে। ছেলে সারাক্ষণ ব্যথায় কাতরাচ্ছে। ছেলের পেছনে প্রায় আট লাখ টাকা চলে গেছে। আমরা আর এ ব্যয়ভার নিতে পারছি না। ডাক্তারের সঙ্গে কথা হলেই বলেন- ‘চিকিৎসা চলছে, আল্লাহকে ডাকেন’।
দেশে এখন অনেকে প্রিজারভেটিভ খাদ্য খাচ্ছে। খাবারে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ও রঙ মেশানো হচ্ছে। এগুলো পরিপাকতন্ত্রে ক্যানসারের জন্য দায়ী। ওরাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে বড় একটি কারণ তামাক। তার মধ্যে একটি হচ্ছে চাবান জাতীয়। যেমন- পান, চুন, জর্দা, গুল ইত্যাদি। পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও ওরাল ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। বিশেষত, গ্রামীণ নারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।- ডা. রোবেদ আমিন
ডাউন সিন্ড্রোমে ভুগছিলেন সাত বছর বয়সী মুশফিক। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি এলাকার বাসিন্দা সে। গত রমজান মাসে তার ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর থেকে হাসপাতালে ভর্তির অনেক চেষ্টা করে গত ১০ মে তাকে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে তার বোন ম্যারো করা হয়েছিল। হাসপাতালে নেওয়ার পর থেকে মুশফিককে নিয়ে এক রুম থেকে অন্য রুমে ছুটছেন তার স্বজনরা।
ক্যানসার রোগীদের রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হয়নি
বাংলাদেশে ক্যানসারের প্রকৃত চিত্র জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে গিয়ে জানা যায়, দেশে এখন পর্যন্ত ক্যানসার রোগীদের রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হয়নি। সরকারের উদ্যোগের অভাবে যা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএসএমএমইউ-এর উদ্যোগে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর এলাকায় ক্যানসার রেজিস্ট্রির একটি পাইলটিং প্রজেক্ট চালু হয়েছে। যেখানে লাখখানেক মানুষের তথ্য নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে প্রতি তিন বছর পর পর একটি হাসপাতাল বেইজড রেজিস্ট্রি প্রকাশ হয়ে থাকে। তবে এ চিত্র এখনো দেশের ক্যানসারের সঠিক চিত্র প্রকাশ করে না।
দেশে ক্যানসারের চিকিৎসাসেবা তুলনামূলক এগোলেও এখনো ভালো অবস্থানে যেতে পারেনি। এখানে বিশাল ঘাটতি আছে। সরকার ক্যানসারের চিকিৎসায় আরও আটটি নতুন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করছে। তবে দেশে যে পরিমাণ ক্যানসারের রোগী তাতে শুধু সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দিলে হিমশিম খেতে হবে। এজন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।-অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) ও বিএসএমএমইউয়ের পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্ট যৌথভাবে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের রেজিস্ট্রির পাইলটিং প্রজেক্ট পরিচালনা করছে। এরই মধ্যে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে। এ বছরের জুন-জুলাইয়ের দিকে জরিপে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করা হবে।
এনসিডিসির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জাগো নিউজকে জানান, এই লাখখানেক মানুষের ওপর চালানো জরিপে প্রায় ১১১ জন ক্যানসার আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে কোনো রেজিস্ট্রি বা সঠিক তথ্য নেই। শুধু জাতীয় ক্যানসার হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে হাসপাতালে আসা রোগীদের রেজিস্ট্রার আছে। কিন্তু তা সারাদেশের চিত্র দেখায় না।
জরায়ুমুখে ক্যানসারের যে লক্ষণ দেখে এখনই সতর্ক হবেন
ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে ৭৫ শতাংশের বেশি
তিনি বলেন, হাসপাতালের চিত্র দিয়ে চিকিৎসা বিষয়ে ধারণা নেওয়া যায়। কিন্তু দেশে ক্যানসারের সঠিক চিত্র দেখতে হলে জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেখতে হবে। দেশে এ ধরনের তথ্য না থাকায় সম্প্রতি হোসেনপুরে একটি জরিপ চালানো হয়েছে। ওই এলাকায় মোট জনসংখ্যা আড়াই লাখের মতো, যেখানে লাখখানেক মানুষের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে।
দেশে ক্যানসার চিকিৎসায় নেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, ঘাটতি অনেক
‘জরিপে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ১১১ জন ক্যানসারে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। আর পুরুষরা সবচেয়ে বেশি খাদ্যনালির ক্যানসারে আক্রান্ত। এর পরই আছে ওরাল ক্যানসার এবং ফুসফুসের ক্যানসার। নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত স্তন ক্যানসারে। এর পরই আছে ওরাল ক্যানসার ও জরায়ুমুখের ক্যানসার। জরিপ প্রকাশের ক্ষেত্রে লাখে কতজন আক্রান্ত সে হিসাবটাই দেখতে হয়। আর এ হিসাবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে আক্রান্তের হার অনেকটাই বেশি।’
চিকিৎসকরা বলছেন, পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের প্রকোপ বেশি এবং নারীদের মধ্যে স্তন ও জরায়ুর ক্যানসার সবচেয়ে বেশি। তারা মনে করেন, দেরিতে ক্যানসার শনাক্ত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। ভেজাল খাবার ও জাংক ফুডের ব্যবহার, অলস জীবনযাপন, দূষণ এবং তামাক ও অ্যালকোহল ব্যবহার বাংলাদেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগী বাড়ার অন্যতম কারণ।
ডা. রোবেদ আমিন বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দেড় লাখের বেশি এবং প্রতি বছর এ রোগী লাখের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা প্রথম দিকে শনাক্ত হয় না। ফলে শুরুতেই তাদের চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা যায় না। এতে আক্রান্ত রোগীর সুস্থ হওয়ার সুযোগ যেমন কমে, অন্যদিকে মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ে।
খাদ্যনালির ক্যানসার আক্রান্ত রোগী বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে এখন অনেকে প্রিজারভেটিভ খাদ্য খাচ্ছে। খাবারে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ও রং মেশানো হচ্ছে। এগুলো পরিপাকতন্ত্রে ক্যানসারের জন্য দায়ী। ওরাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে বড় একটি কারণ তামাক। তার মধ্যে একটি হচ্ছে চাবান জাতীয়। যেমন- পান, চুন, জর্দা, গুল ইত্যাদি। সরকার সিগারেটে কর বাড়িয়ে এর ব্যবহার কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করলেও চাবান জাতীয় তামাকের বিষয়ে পৃথক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের সচেতনতাও অনেক কম। ফলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও ওরাল ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। বিশেষত, গ্রামীণ নারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
দেশে ক্যানসার চিকিৎসায় নেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, ঘাটতি অনেক
‘আমাদের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ধূমপান খাদ্যনালীর ক্যানসার বা ইসোফেগাল ক্যানসারের জন্য অনেক বেশি দায়ী। এটি পুরুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে’- বলেন ডা. রোবেদ আমিন।
দেশে ক্যানসার চিকিৎসার সক্ষমতা অনেক কম
ক্যানসারের চিকিৎসায় সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ক্যানসার একটি মরণব্যাধি বা জটিল রোগ। এর চিকিৎসাও ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। এ রোগের সব ধরনের চিকিৎসা ও শনাক্তকরণ কোথাও হবে, এমন প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে নেই।
ক্যানসার শনাক্তকরণে শুধু হিস্ট্রো প্যাথলজি করলেই হয় না। সঙ্গে ইমিউনোলজিক্যাল পরীক্ষা, জেনেটিক পরীক্ষাসহ আরও নানাবিধ পরীক্ষা করতে হয়। তবে বাংলাদেশে এখনো সেরকম কোনো প্রতিষ্ঠান বা ল্যাব গড়ে ওঠেনি, যেখানে গিয়ে রোগী সব ধরনের পরীক্ষা করাতে পারেন। ফলে দেখা যায়, একজন রোগী এক জায়গায় একটা পরীক্ষা করলেও তাকে ওই টিস্যু নিয়ে অন্যত্রও ছুটতে হচ্ছে।
ক্যানসার চিকিৎসায় সুখবর দিলেন পুতিন
১০০ রুপিতে ক্যানসারের ওষুধ আনলো টাটা মেমোরিয়াল
চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশেও তারা ক্যানসার রোগীদের পরীক্ষা ও শনাক্তকরণের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে চান। এজন্য প্রয়োজন সরকারের উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা। এছাড়া বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্যাকেজগুলোও ফলো করা যেতে পারে। তবে তারা চান দেশেই ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে ক্যানসার রোগীদের জন্য একটি আধুনিক মানের ল্যাব প্রস্তুত করতে।
ওষুধ কিছু পাওয়া গেলেও মেশিনারিজ সংকট প্রকট
ক্যানসারের আধুনিক কিছু ওষুধ বাজারে এসেছে। তবে এগুলোর দাম অনেক চড়া। সাধারণ ওষুধেরও অনেক দাম। কয়েকটা মেজর হাসপাতালে কিছু ওষুধ ফ্রি দেওয়া হয়। কিন্তু অন্য ওষুধগুলো রোগীকে কিনতে হয়। এছাড়া রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির মেশিনও পর্যাপ্ত নেই। ঢাকার বাইরে রেডিওথেরাপির মেশিন খুবই কম। আর ঢাকায় যে পরিমাণ মেশিন দরকার আছে তার ১০ ভাগের এক ভাগ। এছাড়া রেডিওথেরাপির মেশিনের আধুনিকায়নও হয়েছে। সেসব মেশিন বাংলাদেশে তেমন নেই।
দেশে ক্যানসার চিকিৎসায় নেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, ঘাটতি অনেক
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসায় যথেষ্ট আন্তরিক। দেশের আট বিভাগে ক্যানসারসহ বিশেষ চিকিৎসার জন্য আটটি হাসপাতাল করা হচ্ছে। সেখানে কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি ও ক্যানসার- এ তিনটি রোগের চিকিৎসা হবে। তবে দেশে ক্যানসার চিকিৎসায় চিকিৎসক সংকটও রয়েছে। রেডিওথেরাপিস্ট, কেমোথেরাপিস্ট ও ক্যানসার স্পেশালিস্টের সংখ্যাও অনেক কম। আগে এ রোগের বিষয়ে চিকিৎসকদের আগ্রহ কম থাকলেও এখন অনেকটা বেড়েছে। তবে তাদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে স্পেশালিস্ট হয়ে আসতে সময় লাগবে।
রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটের তথ্যে জানা যায়, ওই হাসপাতালে মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার রোগী আউটডোরে চিকিৎসা নিতে যান। প্রতিদিন হাজারের বেশি রোগী আউটডোরে চিকিৎসা নেন এবং ১০ থেকে ১৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হন। মাঝে মাঝে দৈনিক রোগী ভর্তির এ সংখ্যা ২০ জনও ছাড়িয়ে যায়।
হাসপাতালে আসা রোগীদের মাঝে ক্যানসারের চিত্র দেখতে এপিডেমিওলোজি বিভাগে গেলে সেখান থেকে জানানো হয়, প্রতি তিন বছর পর পর একবার ক্যানসার রোগীদের রেজিস্ট্রি প্রকাশ করা হয়। সবশেষ ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের রেজিস্ট্রির তথ্য পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ হয়েছে ২০২১ সালে। তবে ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তথ্য এখনো প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে জনবল সংকটের কথা জানান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. জহিরুল ইসলাম। ওই বিভাগে তিনি ছাড়া আর কোনো চিকিৎসক নেই বলেও জানান তিনি।
জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রোগীদের রেজিস্ট্রির বিষয়টি দেখভাল করেন এপিডেমিওলোজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. জহিরুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এ বিভাগে রেজিস্ট্রির দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে আমাকে একা পালন করতে হয়। বিভাগে জনবল খুবই কম। ফলে সময়মতো রেজিস্ট্রির কাজ শেষ করা সম্ভব হয় না। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের রেজিস্ট্রির কাজ এখনো চলমান। আগামী চার মাসের মধ্যে কাজ শেষ করে রেজিস্ট্রির পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করতে পারবো।
দেশে ক্যানসার চিকিৎসায় নেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, ঘাটতি অনেক
সর্বশেষ ২০২১ সালে ক্যানসার রেজিস্ট্রি প্রকাশ করেছে জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এতে ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। তথ্যানুযায়ী, এ তিন বছরে ৮৩ হাজার ৭৯৫ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ বা ৩৫ হাজার ৭৩৩ জন ক্যানসার আক্রান্ত এবং প্রাথমিকভাবে ক্যানসার ধারণা করা হয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত পুরুষরা ৫৫ শতাংশ বা ১৯ হাজার ৫৪৬ জন আর নারী ৪৫ শতাংশ বা ১৬ হাজার ১৮৭ জন।
এ তিন বছরের তথ্যে আরও জানা যায়, হাসপাতালে আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ফুসফুস ক্যানসারের রোগী। যা মোট আক্রান্তের ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ বা ৬ হাজার ২২৭ জন। এর পরেই রয়েছে ব্রেস্ট ক্যানসার, ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ বা ৪ হাজার ৮০৫ জন। এরপর প্রধান ১০টি ক্যানসারের মধ্যে রয়েছে জরায়ুমুখের ক্যানসার, খাদ্যনালির ক্যানসার, পাকস্থলীর ক্যানসার, লিভার, লিম্প নোড, মলদ্বারের ক্যানসার, মুখের ক্যানসার ও গল ব্লাডারের ক্যানসার।
পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ফুসফুসের ক্যানসার, খাদ্যনালীর ক্যনসার ও পাকস্থলীর ক্যানসার। নারীদের মধ্যে বেশি ব্রেস্ট ক্যানসার, জরায়ুমুখের ক্যানসার ও ফুসফুসের ক্যানসার।
সাভারের ট্যানারি থেকে নির্গত ধাতুর কারণে ক্যানসার হচ্ছে
‘বিশ্বের ক্যানসার রাজধানী’ ভারত, রোগী বাড়ছে হু হু করে
প্রকাশিত ওই তথ্যে আরও জানা যায়, তিন বছরে যারা ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে ৩ হাজার ৯২৩ জন। এরপরই চট্টগ্রাম বিভাগে ২ হাজার ৬৫৮ জন, রাজশাহীতে ৮০৪ জন, খুলনা ১ হাজার ৩৯ জন, বরিশালে ১ হাজার ৩১৬ জন, সিলেটে ৩৩৭ জন, ময়মনসিংহে ১ হাজার ১৬১ জন ও রংপুর বিভাগে ৪৮৫ জন।
দেশে ক্যানসার চিকিৎসায় নেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, ঘাটতি অনেক
তিন বছরের চিত্রে বড় কোনো পার্থক্য নেই
অধ্যাপক ডা. জহিরুল ইসলাম বলেন, যতটুকু দেখেছি ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের তথ্যের সঙ্গে ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের তথ্যের খুব বেশি পার্থক্য নেই। ক্যানসারের বিশাল সংখ্যক রোগী দেশের বাইরে চিকিৎসা নেন। তবে করোনাকালীন দেশের বাইরে যেতে না পারায় এই রোগীদের অনেকে দেশেই চিকিৎসা নিয়েছেন, অনেকে কেমোথেরাপিও নিয়েছেন। এতে রেজিস্ট্রিতে রোগীর সংখ্যা কিছুটা বাড়বে। এবারের তথ্যেও পুরুষদের ফুসফুসের ক্যানসার ও নারীদের স্তন ক্যানসার সবচেয়ে বেশি রয়েছে।
তবে এ ধরনের তথ্যে দেশে ক্যানসারের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না জানিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এ রোগের রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান ডা. জহিরুল। তিনি মনে করেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও গ্রামের কমপক্ষে পাঁচ লাখ এবং শহরাঞ্চলের অন্তত ১০ লাখ মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে ক্যানসার রোগীদের একটি চিত্র তুলে আনা সম্ভব হতে পারে।
ক্যানসার এপিডেমিওলোজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন জাগো নিউজকে বলেন, ক্যানসারের রেজিস্ট্রি তৈরি করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ক্যানসার হাসপাতাল বা দেশের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যারাই এ রোগ নিয়ে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করতে আগ্রহী তাদেরই সুযোগ দেওয়া উচিত। সরকারের উচিত সেগুলো মনিটরিং করা।
‘এছাড়া দেশে ক্যানসারের চিকিৎসাসেবা তুলনামূলক এগোলেও এখনো ভালো অবস্থানে যেতে পারেনি। এখানে বিশাল ঘাটতি আছে। সরকার ক্যানসারের চিকিৎসায় আরও আটটি নতুন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করছে। তবে দেশে যে পরিমাণ ক্যানসারের রোগী তাতে শুধু সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দিলে হিমশিম খেতে হবে। এজন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
ডা. রাসকিন বলেন, তারা (বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো) চিকিৎসার যন্ত্রপাতি আমদানিতে ট্যাক্সের যেসব সুবিধা পায় তার বিনিময়ে ১০ শতাংশ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার কথা। তারা তা দিক। কিন্তু বর্তমানে তা দেওয়া হচ্ছে না। হাসপাতালগুলো কথা রাখছে না। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও ক্যানসারের চিকিৎসায় বিত্তশালীদের এগিয়ে আসা উচিত। এছাড়া হেলথ বিমা চালু করা যেতে পারে। যেন রোগীরা অর্থের কথা চিন্তা না করে চিকিৎসাটা ভালোভাবে নিতে পারেন।