৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
হাজারের বেশি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন মাদারীপুরের মাহমুদা আক্তার কণা। দিন নেই রাত নেই যখনই কোনো বাল্যবিয়ের কথা শুনেছেন সেখানে ছুটে গিয়ে তা বন্ধ করেছেন। মাদারীপুর জেলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এজন্য তাকে হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছে। তবুও তিনি বাল্যবিয়ে বন্ধে বদ্ধপরিকর।
মাহমুদা আক্তার কণা বর্তমানে মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত। চেনা নেই, জানা নেই, যে কেউ ফোন করে বা অফিসে গিয়ে বাল্যবিয়ের তথ্য দিলেই কোনো অবহেলা নেই তার। সরাসরি কিংবা অফিসের লোক পাঠিয়ে বন্ধ করে দেন সেই বিয়ে। অনেক সময় নানা ধরনের হুমকি, ভয়ভীতি দেখানো হলেও দমে যাননি তিনি। প্রভাবশালীদের চাপের মুখেও তিনি বন্ধ করেন বাল্যবিয়ে। সমাজ থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধ করাই তার একমাত্র লক্ষ্য। তার উদ্যোগে বন্ধ হয়েছে মাদারীপুরের হাজারো বাল্যবিয়ে।
মাদারীপুর সদর উপজেলার শ্রীনদী ইউনিয়নের শিরখাড়া এলাকার ইলিয়াস হোসেন বাদলের সঙ্গে প্রায় ৩৩ বছর আগে বিয়ে হয় মাহমুদা আক্তার কণার। বাবার বাড়ি রাজৈরের ইশিবপুর সাতবাড়িয়া এলাকায়। বাবা সিরাজুল হক মিয়া ছিলেন মাদারীপুরের এআর হাওলাদার জুট মিলের ম্যানেজার। শহরের কলেজ গেট এলাকায় একটি ভাড়াবাসায় থাকেন তিনি। বড় মেয়ে নাজিয়া সুলতানা পানী নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছেন। বড় ছেলে নুরুস সাবা রাবিক বিবিএ ও ছোট ছেলে নুরস সাব্বির এলএলবি পড়ছেন।
চাকরির সুবাদে পটুয়াখালী, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, শিবচর, রাজৈরসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন মাহমুদা আক্তার কণা। বর্তমানে তিনি মাদারীপুরে কর্মরত। মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।
স্বামী ব্যবসার কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। কাজের সুবাদে মাহমুদা আক্তার কণাকেও সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়। ছেলে-মেয়েদের তেমন সময় দিতে পারেন না। স্বামীকেও না। তাই তাদের অভিযোগের শেষ নেই। তবুও তিনি সংসার জীবনের সুখ-শান্তি-অভিযোগকে উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন ধরে সমাজের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত নারীদের নিয়ে কাজ করেন তিনি। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য।
মাহমুদা আক্তার কণা বলেন, ১৯৯৯ সাল থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত জেলায় হাজারেরও বেশি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বহু নারীকে সালিশ মীমাংসার মাধ্যমে সুস্থ জীবন ও নির্যাতনকারীর শাস্তির ব্যবস্থা করেছি। অনেক সময় মাঝরাতে ফোন এসেছে। দিন নেই রাত নেই সব সময় ছুটে গিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি। চেনা-অচেনা যে কেউ ফোন দিলেই নিজে না যেতে পারলেও অফিসের লোক পাঠিয়ে বিয়ে বন্ধ করেছি। এজন্য নানা হুমকির মধ্যেও থাকতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চাকরির সুবাদে মাদারীপুর জেলায় কাজ করছি। তাই বর্তমানে মাদারীপুর জেলার বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য জোরালোভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য এই জেলাকে দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থানে নিতে চাই।
শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় কন্যাশিশু দিবসে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন থেকে মাদারীপুর সদর উপজেলাকে বাল্যবিয়ে মুক্ত ঘোষণা করা হবে। এই অর্জন মাদারীপুরবাসীর জন্য আনন্দ এবং গর্বের বিষয় বলেও জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুধখালী গ্রামের এক স্কুলছাত্রী বলেন, আমি পড়ালেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নবম শ্রেণিতে ওঠার পর ইতালী প্রবাসী এক ছেলে পেয়ে আমার বাবা-মা বিয়ে ঠিক করেন। আমি রাজি ছিলাম না। জোর করে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। বরপক্ষও এসে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময় মাদারীপুরের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাহমুদা আক্তার কণা এসে আমার বিয়ে ভেঙে দেন। তাতে করে আমি পড়াশুনার সুযোগ পাই। বর্তমানে আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। সবই সম্ভব হয়েছে তার জন্য। তাই তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
মাদারীপুর সদর উপজেলার থানতলী গ্রামের মিম নামের একজন বলেন, আমার বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছিল। তখন আমি নিজেই মাহমুদা আক্তার কণাকে ফোন দিই। তিনি এসে আমার বিয়ে বন্ধ করেন এবং বাবা-মার কাছ থেকে স্বাক্ষর নেন ১৮ বছরের আগে আমাকে বিয়ে দেবেন না।
চরমুগরিয়া এলাকার সিমা আক্তার, হাজরাপুর এলাকার সুইটি, ছিলারচর এলাকার শিল্পী, পুরানবাজারের তানহারসহ বাল্যবিয়ে বন্ধ করার এমন উদাহরণ রয়েছে মাদারীপুর জেলাজুড়ে।
মাদারীপুরের উন্নয়ন সংস্থা দেশগ্রামের নির্বাহী পরিচালক এবিএম বজলুর রহমান খান বলেন, মাদারীপুরের সবাই বাল্যবিয়ে বন্ধের ব্যাপারে একনামে মাহমুদা আক্তার কণাকেই চেনেন। কোথাও বাল্যবিয়ে হলেই সবাই প্রথমে তাকেই ফোন দেন।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইনউদ্দিন বলেন, শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় কন্যাশিশু দিবসে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন থেকে মাদারীপুর সদর উপজেলাকে বাল্যবিয়ে মুক্ত ঘোষণা করা হবে। এটা মাদারীপুরবাসীর জন্য একটা অর্জন বলে আমি মনে করি।