চট্টগ্রাম নগরের ব্যস্ততম এলাকা আগ্রাবাদ। বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদীর মধ্যবর্তী এ উপদ্বীপ আকৃতির স্থলভাগকে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র বিবেচনা করা হয়। আশপাশে গড়ে উঠেছে একাধিক আবাসিক এলাকা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রতিদিন এসব এলাকা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। বর্ষায় এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান বাহন হয়ে ওঠে নৌকা।
শুধু আগ্রাবাদ নয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি চট্টগ্রাম নগরের জন্য এখন বড় হুমকি। দেড় দশক ধরে এখানে সাগরের জোয়ারের পানির উচ্চতা ক্রমেই বেড়েছে। বর্ষা মৌসুমে মারাত্মক রূপ নিচ্ছে জলাবদ্ধতা। জোয়ারে শহরের উপকূলীয় অংশ ডুবে যাওয়ার পাশাপাশি মূল শহরের অভ্যন্তরেও সাগরের পানি চলে আসছে।
এমনকি শুষ্ক মৌসুমেও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে খাতুনগঞ্জ, বাকলিয়া, শুল্কবহর, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, হালিশহর, জিইসি মোড়, চকবাজার, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। মূলত জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরের অকার্যকর ড্রেনেজ সিস্টেমের কারণে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ পেয়েছে চট্টগ্রামে।
আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্ষা মৌসুম শুরু হলেই আমাদের নিয়মিত জোয়ার-ভাটার ক্যালেন্ডার মেনে বাড়ি থেকে বের হতে ও ফিরতে হয়। এখানকার বাসিন্দাদের জানতেই হয় কখন জোয়ার আসবে। অন্যথায় জোয়ারের পানিতে সমস্যা পোহাতে হয়। জোয়ারের সময় পানিতে ডুবে যায় পুরো এলাকার রাস্তাঘাট ও বাড়ির নিচতলা।’
গণপূর্ত অধিদপ্তরের জরিপ বলছে, জোয়ারের কারণে চট্টগ্রাম মহানগরের প্রায় ৬৯ শতাংশ এলাকা বছরের নানা সময়ে কম-বেশি প্লাবিত হচ্ছে।
আগ্রাবাদে রোগীদের সেবা দিতে তিন যুগ আগে শুরু হয়েছিল মা ও শিশু হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম। ৩৮ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সেবার মান বাড়াচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নিরবচ্ছিন্ন অত্যাধুনিক সেবা দিতে নানা পদক্ষেপ নিলেও তা গ্রহণ করতে পারেন না দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা। কারণ জোয়ার আর বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় প্রায়ই বন্ধ থাকছে হাসপাতালটির নিচতলার সেবা কার্যক্রম। এতে দুর্ভোগে পড়তে হয় রোগীদের। বিশেষ করে প্রান্তিক এলাকা থেকে আসা রোগীরা বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
মা ও শিশু হাসপাতালের উপ-পরিচালক মো. মোশারফ হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাসপাতালটি যখন প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন পানি উঠতো না। ২০১০ সালের পর থেকে পানি ওঠা শুরু হয়। এখন যত দিন যাচ্ছে ততই হাসপাতালে পানি ওঠার প্রবণতা বাড়ছে। আগে গোড়ালি পর্যন্ত পানি উঠতো, এখন কোমর পরিমাণও পানি জমে।’
তিনি বলেন, ‘জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে আমরা হাসপাতালের চারপাশ উঁচু করেছিলাম। কিন্তু তাতেও রক্ষা হচ্ছে না। সম্প্রতি টানা বৃষ্টিতে কোমর সমান পানি ওঠে। এরপর আমরা যেসব পথ দিয়ে হাসপাতালে পানি প্রবেশ করে সেগুলো রোধ করেছি। হাসপাতালের শৌচাগারগুলো উঁচু করা হচ্ছে।’
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চট্টগ্রাম শহরের উচ্চতা
জরিপ অধিদপ্তর ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চট্টগ্রাম শহরের গড় উচ্চতা এক মিটারেরও কম। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এলাকায় এ উচ্চতা দশমিক দুই মিটারেরও কম। বিপরীতে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় সমুদ্রের পানির উচ্চতা ০.৫ থেকে আড়াই মিটার পর্যন্ত বেড়েছে। এসব এলাকার জোয়ারের পানির গড় উচ্চতা ২.৫ থেকে ২.৭৬ মিটার। অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের পানির স্তর ২.৫-৪.৫ মিটার পর্যন্তও বাড়ে।
শুষ্ক মৌসুমে জোয়ারের সময় সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ে স্বাভাবিকের তুলনায় আড়াই মিটার থেকে দুই দশমিক ৭৪ মিটার। আর বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের সময় সাগরের পানির উচ্চতা হয় প্রায় পাঁচ মিটার। জোয়ারের উচ্চতা নগরীর গড় উচ্চতার চেয়ে বেশি হওয়ায় এখানকার অনেক এলাকাই নিয়মিতভাবে প্লাবিত হচ্ছে। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে মানুষের বাসাবাড়ি, সড়ক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সংকট থেকে পরিত্রাণে বাসিন্দারা সড়ক থেকে বাসাবাড়ির আঙিনা ও সীমানা দেওয়াল উঁচু করছে ইট-সিমেন্ট দিয়ে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অনেক জেলাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চল হলেও এখানে পাহাড়ের কারণে বর্ষা মৌসুমে বালি-মাটি নেমে আসে। এগুলো জমে কর্ণফুলীসহ বেশ কয়েকটি নদী, খাল কিংবা ড্রেনেজ সিস্টেম প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ায় নগরীতে জোয়ারের পানি দীর্ঘসময় ধরে অবস্থান করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।’
প্রতিবছর ২০ মিলিমিটারের বেশি ডুবছে চট্টগ্রাম নগরী
২০১৫-২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৯৯ শহরের নিমজ্জনের গতি পর্যবেক্ষণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রোড আইল্যান্ডের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ওশেনোগ্রাফির তিন বিশেষজ্ঞ। তাদের সে গবেষণায় পাওয়া ফলাফল অনুযায়ী গোটা বিশ্বে এখন সবচেয়ে দ্রুতগতিতে সমুদ্রে নিমজ্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে চীনের তিয়ানজিং শহর। শহরটি ২০১৫-২০ সাল পর্যন্ত সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছে বছরে গড়ে ৪০ মিলিমিটারেরও বেশি গতিতে, যা বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠের বার্ষিক গড় উচ্চতা বৃদ্ধির (২ মিলিমিটার) ২০ গুণেরও বেশি।
এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও ফিলিপাইনের ম্যানিলা। এ দুই শহরে বার্ষিক গড় নিমজ্জনের গতি ২০ মিলিমিটার ছাড়িয়েছে। সে হিসেবে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বৃদ্ধির তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি গতিতে ডুবছে চট্টগ্রাম। পাকিস্তানের করাচি ডুবছে বছরে ১০ মিলিমিটারের বেশি বা বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বৃদ্ধির পাঁচ গুণেরও অধিক। গবেষণায় এ চার শহরের দ্রুত নিমজ্জনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ব্যাপক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনকে।
২০২২ সালে অ্যাডভান্সিং আর্থ অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স প্রকাশিত জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স জার্নালে এ গবেষণাটি প্রকাশ হয়।২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্টিমসন সেন্টারের পক্ষ থেকে ‘মেজারিং মাল্টি ডাইমেনশনাল ক্লাইমেট রিস্ক ইন চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রকাশ হয়। জাপানের সাসাকাওয়া ফাউন্ডেশনের ওশান পলিসি রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওপিআরআই) ও স্টিমসন সেন্টারের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বাংলাদেশের ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক যৌথভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করে।
গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমান অবস্থায় চট্টগ্রামে উপকূলীয় ভূমিক্ষয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির গতি বেড়ে যাওয়া, ভূমিধস, মেট্রোপলিটন এলাকায় প্লাবিত হয়ে পড়া এবং উপকূলীয় জলাধারে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এছাড়া চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় (স্কোর ৮ দশমিক ৩৮) এবং এতে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা বৃদ্ধির (৮ দশমিক ৩) দিক থেকেও চট্টগ্রাম এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে এতে উঠে আসে।
জরিপভিত্তিক এ গবেষণায় স্টিমসন সেন্টার উদ্ভাবিত ক্লাইমেট অ্যান্ড ওশান রিস্ক ভালনারেবিলিটি ইনডেক্স (সিওভিআরআই) ব্যবহার করা হয়। এজন্য ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী শূন্য থেকে ১০ পর্যন্ত স্কোরিং করা হয়। সিওভিআরআই সূচকে স্কোর যত বেশি হয়, ঝুঁকির মাত্রা তত বেশি।
গবেষকদের একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আমীর মুহাম্মদ নসরুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ২০৫০ সালের মধ্যে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অংশের অনেক ভূমি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। এতে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে।’