০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ডলার এখনো ব্যবসায়ীদের ‘গলার কাঁটা’। চাহিদা অনুযায়ী ডলার সংস্থান করতে পারছে না তারা। এতে শিল্পের কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে তৈরি হচ্ছে সমস্যা। যে পরিমাণ ডলার সংস্থান হচ্ছে তা দিয়ে এলসি খোলায় বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। অনেক ছোট ব্যবসায়ী ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হচ্ছেন। এরই মধ্যে চলতি মাসের শুরুতে ডলারের দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে এবিবি ও বাফেদা।

ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি-রপ্তানিতে পড়বে প্রত্যক্ষ প্রভাব। যার আঁচ লাগবে ভোক্তার গায়েও। পণ্য আমদানিতে ব্যয় বাড়বে। যদিও রপ্তানিকারকরা আগের চেয়ে এখন বেশি টাকা পাচ্ছেন। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নকে ভালো চোখে দেখছেন না আমদানি-রপ্তানিকারকরা। তাদের মতে, ডলারের দাম একটি যৌক্তিক পর্যায়ে এলে সবার জন্যই সেটা মঙ্গল। সমস্যা সমাধানে ডলারে সিঙ্গেল এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণ, মানি লন্ডারিং বন্ধ ও রেভিনিউ আদায়ের কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

গত এক বছরে এক ডলারের বিপরীতে ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ১৬ টাকা। গত বছরের জুনে প্রতি ডলারের জন্য ব্যবসায়ীদের ব্যয় হয় প্রায় ৯২ টাকা, চলতি বছরের আগস্টে যা বেড়ে ১০৯ টাকা হয়েছে। অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়ায় অনেক ছোট-বড় ব্যবসায়ী ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছেন না।

কথা হয় নবাবপুরের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। আমদানিকারক এ ব্যবসায়ী বলেন, এর আগে ডলার সংকটে এলসি খোলায় সমস্যা তৈরি হয়েছিল। ডলারের দাম বাড়ায় নতুন করে এলসি খোলায় খরচ বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। ইলেকট্রিক পণ্যে ২৫ শতাংশ বা তার বেশি দাম বেড়েছে। ডলারের রেট সহনীয় পর্যায়ে থাকলে ভালো হয়।

ভারত ও চীন থেকে পণ্য আমদানি করেন বাপ্পি। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, একদিকে ডলার সংকট অন্যদিকে ডলারের দাম বেশি। এ দুই কারণে আমাদের ব্যবসায় মন্দাভাব তৈরি হয়েছে। অনেকেরই ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার মতো অবস্থা। তবে সংকট সমাধানে ডলার সরবরাহ বাড়াতে হবে ইউনিফর্ম রেটে। এতে সব পণ্যের দাম, বিশেষ করে আমদানি পণ্যের দাম কমে আসবে।

চলতি মাস থেকে রেমিট্যান্স ডলারের দাম বাড়িয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে রপ্তানি আয়ে ডলারের দামও। ফলে এখন থেকে রপ্তানিকারকরা প্রতি ডলারে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা পাবেন। এতদিন যা ছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। আর রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। এতদিন যা ছিল ১০৯ টাকা। এছাড়া আমদানিতে ডলারের দর হবে ১১০ টাকা। আগে যা ছিল ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা।

বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের সিইও মো. আফজাল করিম জাগো নিউজকে বলেন, অনেক দিন ধরে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের রেট এক করার চেষ্টা চলছিল। এখন থেকে এটি কার্যকর হবে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বিল নগদায়নে ডলার রেটে কোনো পার্থক্য নেই। এতে রপ্তানিকারকরা আরও উৎসাহিত হবেন।

তবে ডলারের রেট বাড়ানোয় রপ্তানিকারকরা কিছুটা বেশি পয়সা পেলেও সহনীয় পর্যায়ে রাখার কথা বলেন অনেকে। বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডলারের দাম বাড়লেও ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে পুরোটা চলে যায়। সব জিনিসের দাম বেশি। ভালো একটা পর্যায়ে রাখা হলেই ভালো হয়। এতে কেউ দাম বেশি রাখতে পারবে না। মনিটরিং করতে হবে।’

ডলারের দাম বাড়া নিয়ে কথা হয় বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি এবং ফতুল্লা অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসানের সঙ্গে। ডলারের দাম বাড়লে লাভ-ক্ষতি বিষয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে ডলারের পুরোটা চলে যায়। আবার যে পরিমাণ টাকা থাকে জিনিসের দাম বাড়ার কারণে, ডলারের দাম বাড়ার কারণে সেটা আবার ব্যবসায়ীদের ওপর চলে আসে। ফলে দু’এক শতাংশ লাভের টাকা যদি বাড়ে সেটা আসলে দেশের জন্য অতো মঙ্গলজনক নয়। ভারসাম্য থাকলে ব্যবসা করতে সুবিধা হয়।’

এ ব্যবসায়ী জানান, ব্যাংকে ডলারের রেট বাড়ার কারণে আগে যে পরিমাণ ডলারের আমদানি করতে পারতাম এখন তার ৩০ শতাংশ কম করতে পারছি। অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। নতুন একটি মেশিন কিনতে হলে অনেক বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

ডলার সমস্যায় কমেছে এলসি খোলা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম মাস অর্থাৎ জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৪৩৭ কোটি ২৪ লাখ ডলার বা ৪ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের (জুলাই) চেয়ে ৩১ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ৭৪৯ কোটি ১৮ লাখ ডলার বা ৭ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র বা এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, গত অর্থবছরের একই মাসে (জুলাই) ৫৯৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল।

এসব বিষয়ে কথা বলেন সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘রপ্তানিতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি আরএমজি সেক্টরের জন্য উপকার হয়েছে। এতে কোনো ডিউটি নেই, অফিসিয়াল রেটে আশির দশক থেকে বেনিফিট পাচ্ছে তারা। ডলারের তিন/চারটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এর মধ্যে মাল্টিপল রেট চলবে না। এখানে আমদানির একটা, রপ্তানির জন্য একটা রেট, রেমিট্যান্সের আলাদা রেট- এগুলো চলবে না। সিঙ্গেল রেট হতে হবে, যেটা বিশ্বে চলে।

সাবেক এ গভর্নর বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে রিয়েল এক্সচেঞ্জ রেট ক্যালকুলেট করে সেই বেসিসে ডলারের একটা রেট নির্ধারণ করেছি। ১০ বছর পর্যন্ত টাকাকে অবমূল্যায়ন না করার ফলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়। অবমূল্যায়ন দশ বছরে ভারত করেছে ৭৭ শতাংশ আমরা করেছি ২৭ শতাংশ। এতে আমার টাকাটা অতিমূল্যায়িত হয়ে গেছে, আমার এক্সপোর্ট কমপিটিটিভ ছিল না। তখন ইম্পোর্টাররা পছন্দ করেছে কারণ তারা কম টাকায় কম দামে ডলার কেনে।