২৯ আগষ্ট ২০২৩

 

লেখকঃ মোঃ হায়দার আলীঃ  মাদকের কারণে যুব সমাজ আজ ধ্বংসের পথে, এদের বাঁচাতে না পারলে সমাজ দেশের ব্যপক ক্ষতি হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এক সময় লুকিয়ে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার তালিকাভুক্ত মাদ্রক মাদক ব্যবসায়ী ও সম্রাটরেরা এলাকায় ফিরে এসে বীর দাফটে তাদের অবৈধ মাদক কারবার শুরু করেছেন। এটা সমাজ, দেশের জন্য সুখকর হতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী  শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করলেও মাদক কারবার বন্ধ হচ্ছে না।  বরং বেড়েই চলেছে মাদক কারবার। মাদক ব্যবসায়ীরা লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচের বিনিময়ে বিনিময়ে বিএনপি ও আওয়ামীলীগের পদ পদবী বাগিয়ে নিয়েছেন, বিভিন্ন সংস্থার তালিকাভুক্ত মাদক সম্রাট, মাদক ব্যবসায়ীরা। এক এক জনের বিরুদ্ধে ৩/৪ টি বেশী মাদকের মামলা চলমান রয়েছে অথচ ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা  উৎকোচ দিয়ে হয়েছেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন থেকে পৌরসভার, উপজেলা পর্যায়ে  সভাপতি, সাধারন সম্পাদক, সাংগাঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদ পেয়েছেন। ওই সব হাইব্রিড,  পরগাছা, অনুপ্রবেশকারী নেতারা পদ পেয়ে গঠনতন্ত্র বিরোধী কর্মকাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ছেন, মাদক, টেনাডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, খাসপুকুর দখল, সরকারি খাদ্যগুদামে রাতারাতি গম, ধান, চাল অবৈধভাবে প্রবেশ করিয়ে  অঙ্গুল ফুলে কলাগাছ, তার পরে বটবৃক্ষ হয়েছেন। তারা এখন দল থেকে বহিস্কার হচ্ছেন। পদ হারিয়েও যেন তারা কোটিপতি,  ফুলে ফেঁপে উঠেছে।  শুধু কি তাই নির্বাচনে কালো টাকার  প্রভাব খাটিয়ে হয়েছেন মেম্বার, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, মেয়র। তারা নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে মাদক ব্যবসাকে আরও উৎসাহিত করছেন। কিছু অসৎ পুলিশ, ডিবি পুলিশ সদস্য, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকতা,  মাদকব্যবসায়ীদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার অভিযোগ অনলাইন, স্থানীয়, জাতীয় পত্রিকা, টিভি সংবাদে উঠে এসেছে। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় মাদক দ্রব্যের উপস্থিতি সুপ্রাচীনকাল থেকেই। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ বছর আগে মেসোপটেমিয়া,  এসিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে আফিমের নেনাক প্রমাণাদি পাওয়া যায়
বাংলার প্রাচীনতম কাব্য চর্চা পদেও তার যথেষ্ট প্রমান রয়েছে। সবচেয়ে প্রাচীন মাদকটির নাম হচ্ছে আফিম  গাঁজা, ফেনসিডিল, নতুন সংযোজন হয় ইয়াবা। এ ছাড়া গাঁজা, আফিম, চরশ, বাংলা মদ, গুল, মরফিন, কোকেন, বিয়ার, ওয়াইন, হেরোইন, প্যাথেলিন, মারিজুয়ানা, ডেক্রপরটেন, প্যাথেডিন কোকেন চোলাইমদসহ বর্তমানে  মাদক, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীর তালিকা  দিনে দীর্ঘ হচ্ছে। কোন ভাবে থামানো যাচ্ছেনা এ অবৈধ মাদক কারবার। ফলে সব চেয়ে ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছে যুব সমাজ। দেশে মাদকের বিস্তৃতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তরুণ ও যুবসমাজ ব্যাপক হারে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।

মাদকে আক্রান্ত তরুণ ও যুবসমাজ ধ্বংসের পথে। বর্তমান সমাজে মাদক জন্ম দিচ্ছে একের পর এক অপরাধ। শুধু মাদকের কারনে ছেলের হাতে বাবা মা ভাই, স্ত্রী হাতে স্বামী, স্বামীর হাতে স্ত্রী, প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা, প্রেমিকার হাতে প্রেমিক খুন হওয়ার কথা পত্র পত্রিকায় খবর বের হয়েছে।

মাদকের ছোঁয়ায় সম্ভাবনাময় তারুণরা অধঃপতনের চরম শিখরে উপনীত হচ্ছে। মাদক এখন সহজলভ্য। রাজধানী শহর-নগর, গ্রামসহ মফস্বল এলাকায়ও হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। আশির দশকের শেষ দিকে ফেনসিডিলের আবির্ভাব হয়। পর্যায়ক্রমে এটার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। নব্বইয়ের দশকে মাদকের জগতে সংযোজন হয় ইয়াবা। এ ছাড়া গাঁজা, আফিম, চরশ, বাংলা মদ, গুল, মরফিন, কোকেন, বিয়ার, ওয়াইন, হেরোইন, প্যাথেলিন, মারিজুয়ানা, ডেক্রপরটেন, প্যাথেডিন কোকেন চোলাইমদসহ রকমারি মাদকের প্রতি তরুণদের আসক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বিধ্বংসকারী মাদকের বিস্তার সমাজে যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে সচেতন অভিভাবক মহল, প্রশাসনও উদ্বিগ্ন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরের ওপরে শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। না বুঝেই অনেক তরুণ এ পথে পা দিয়ে বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, মাদক সেবনের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৮০ লাখ মানুষ এবং বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যায়। বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি।

মাদকাসক্ত সন্তানের কারণে এক একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মাদকাসক্ত সন্তানকে নিয়ে পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ছে। পথশিশুরাও আজ ভয়াবহ নেশায় আসক্ত হচ্ছে। মাদকের নেশা কেবল আত্মঘাতী নয়, সমাজ, দেশ, মনুষ্যত্ব সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী ডেকে আনছে বিপর্যয়। ব্যক্তিজীবনে যেমন মাদক স্বাস্থ্য, সম্পদ, মানসম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি নষ্ট করে ব্যক্তিকে করে তোলে সমাজের ঘৃণা ও নিন্দার একশেষ, তেমনি সমাজজীবনেও আনে অস্বাস্থ্য, অলসতা, অকর্মণ্যতা এবং সামাজিক অপরাধের সীমাহীন নিষ্ঠুরতা। ধ্বংস হয়ে যায় মাদকসেবীর রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকরি, সামাজিক মূল্যবোধের মতো অমূল্য গুণগুলো। আজকের পৃথিবীতে এই ব্যাধি পরিব্যাপ্ত দেশ থেকে দেশান্তরে। নেশার উপর ভর করে একদল নেশার ব্যবসায়ী আজ মানুষ কর্তৃক মানুষ মারার নেশায় বুঁদ হয়ে ধ্বংস করতে যাচ্ছে বিশ্বের সর্বজনীন মূল্যবোধ, প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-ভক্তি রসধারাকে সীমাহীন আত্মঘাতী নিষ্ঠুরতায়।

নেশায় নেশায় বুঁদ এসব নেশার কারবারিরা আজ নেশার বাণিজ্য সম্ভারে মেতে বিশ্বকে করে তুলেছে সন্ত্রস্ত। তাই ড্রাগ কেবল ব্যক্তিজীবন নয়, সমাজ, সমষ্টি, দেশ এবং বিশ্বজীবনেও ডেকে আনছে বিপর্যয় সমাজসেবা অধিদফতরের এক গবেষণায় দেখা যায়, শহর, গ্রাম থেকে নিয়ে স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মাদকাসক্ত হচ্ছে। দেশের ভিতরে  যত্রতত্র চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। প্রতিনিয়িত বসছে নেশার আড্ডা। অনেকে নেশার টাকা জোগাড় করতে নেমে পড়ছে অপরাধ জগতে। মাদকের চাহিদা মেটাতে তরুণ-তরুণীরা ক্রমেই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। অনেক শিক্ষার্থী নেশার মোহে পড়ে সম্ভাবনাময় জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে একজন মানুষ যখন অপরাধজগতে পা বাড়ায়, প্রথম সিঁড়িটি হলো মাদকদ্রব্য। সিগারেট হলো মাদকাসক্তির মূল কারণ।

একজন মানুষ প্রথমেই কিন্তু মাদক সেবন করে না। প্রথমে যেটা করে সেটা হলো সিগারেটের নেশা। এই নেশা থেকে আস্তে আস্তে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মাদকের নেশায় আসক্ত বেশির ভাগই শুরু হয় বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যে। মাদক গ্রহণের ফলে প্রাথমিক সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী স্বস্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর মরণ ফাঁদ। এই মরণ ফাঁদে একবার পড়লে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, সৃজনীশক্তি শেষ হয়ে যায়।

পারিবারিক বিপর্যয়গুলো বিশেষজ্ঞদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। এই সর্বনাশ মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্রকে মোটেও বিচলিত করে না। তারা কেবলই বোঝে ব্যবসা। তরুণ প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছে মরণনেশার উপকরণ মাদক। তরতাজা তরুণদের মেধা, বিবেক, লেখাপড়া, মনুষ্যত্ব সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে ইয়াবার ভয়াবহ নেশা। বিনষ্ট করে দিচ্ছে স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা, পারিবারিক সুবন্ধন। মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে অহরহ বাবা-মা, ঘনিষ্ঠ স্বজন নির্মম হত্যার শিকার হচ্ছে। নেশাখোর বাবা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে প্রিয় সন্তানকে খুনও করছে অবলীলায়। নেশার টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, মাকে জবাই করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো জঘন্য ঘটনাও ঘটছে।

প্রতিবছর দেশে ঘটা করে ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘People first: stop stigma and discrimination, strengthen prevention’. অর্থাৎ ‘মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে কলঙ্ক ও বৈষম্য বন্ধ করুন, প্রতিরোধ জোরদার করুন’। এর নিহিতার্থ হলো, মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের প্রতি বৈষম্য দূর করতে ও সহানুভূতি দেখাতে হবে, যাতে করে তারা তাদের সমস্যাটির
জন্য সহযোগিতা নিতে পারেন এবং সর্বোপরি প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। মাদকাসক্তি বর্তমান বিশ্বের ক্রমবর্ধমান সমস্যাগুলোর অন্যতম। আমাদের আশপাশে আত্মীয়-পরিজন কিংবা বন্ধু-বান্ধব কারও এ সমস্যা থাকলে তাকে সবাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। এমনকি তার পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণ করে। যেমন-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারকে অপমান করা, যোগ্যতা থাকলেও কর্মক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত করা, পুলিশ প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়া ইত্যাদি। সমাজের এসব নেতিবাচক আচরণের ভয়ে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিবারও অনেক সময় মাদক সমস্যার সমাধানে কারও কাছে সহায়তা চাইতে লজ্জা ও সংকোচবোধ করে এবং সমস্যাটি সামনে নিয়ে আসতে চায় না। ফলস্বরূপ, সমস্যার তীব্রতা যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়, তখন মাদকনির্ভর ব্যক্তির সমস্যার ধরন অনুযায়ী কী ধরনের চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন, তা বিবেচনা না করেই চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে ভর্তি করে। আবার কখনো মাদকাসক্ত ব্যক্তির ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হয়।

গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, অন্যান্য রোগের মতোই মাদক সমস্যা একটি রোগ। এ রোগকে বলা হয় ‘ক্রনিক রিল্যাপ্সিং ব্রেন ডিজিজ’। সঠিক নিয়মে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে এভিডেন্স বেজ্ড ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব এবং চিকিৎসা-পরবর্তী নিয়মিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগীর সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরাও চিকিৎসার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাজ করতে পারেন না। নেশায় আসক্ত হওয়ার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। কিন্তু কারণ যাই হোক না-কেন, নেশা সমাজের প্রধান পাঁচটি অংশকে অর্থনৈতিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই অংশগুলো হচ্ছে স্বাস্থ্য, উৎপাদন, অপরাধ, নিরাপত্তা এবং সরকারি কার্যপ্রণালী। প্রথমেই আলোচনা করা যাক স্বাস্থ্য সম্পর্কে।

নেশা মানুষের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত করে তোলে। মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবন রোগীর মানসিক অবসাদ ঘটায় এবং হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভি-এইডস ও যক্ষ্মার মতো ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই নেশাবিরোধী অভিযান, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন কর্মসূচিতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং ঘন ঘন রোগে আক্রান্ত হওয়া কিংবা মারা যাওয়া উভয় ক্ষেত্রেই দেশের প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, নেশাবিরোধী অভিযান সরকারি অর্থের সুরক্ষা করতে পারে।
নেশাগ্রস্ত লোক যে শুধু নিজের ক্ষতি করে এমন নয়, পারিপার্শ্বিক মানুষের নিরাপত্তাও সঙ্কটাপূর্ণ করে তোলে। নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালালে পথ দুর্ঘটনায় চালকের যেমন ক্ষতি হয় পথযাত্রীদের সমান খেসারত দিতে হয়। গবেষণায় জানা গেছে, ভাং খেয়ে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনার আশঙ্কা ৯.৫ গুণ এবং কোকেন ও ব্যাঞ্জোডায়াজিপাইনের ক্ষেত্রে ২ থেকে ১০ গুণ বৃদ্ধি পায়। এম্ফিটামিন ড্রাগে এই আশঙ্কা ৫ থেকে ৩০ গুণ এবং মদের সঙ্গে অন্য ড্রাগ মিশিয়ে খেলে ২০ থেকে ২০০ গুণ বৃদ্ধি পায়।

বিশ্বের প্রায় সবক’টি মহাদেশেই অবৈধ মাদক উৎপাদিত হয় কিংবা ব্যবহৃত হয়, যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশও এই বিষয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশে আফিম ও ভাং এর প্রচলন সুপ্রাচীন। বিগত তিন দশকে হেরোইন, এম্ফিটামিন, কোকেন এবং নানা ভেষজ ওষুধ রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে প্রবেশ করেছে, যা অবৈধ মাদকের ভয়াবহতাকে আরও উসকে দিয়েছে। এক সময় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল অর্থাৎ মায়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ড কিংবা গোল্ডেন ক্রিসেন্ট অর্থাৎ আফগানিস্তান, ইরান ও পাকিস্তান থেকে অবৈধ ড্রাগ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে শুধু পাচার হতো। কিন্তু আজ এই চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইয়াবা নামক নেশা দ্রব্য আজ সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সৃষ্ট করছে নানা বিপর্যয়।

এক বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ লক্ষ নেশাসক্তদের মধ্যে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের সংখ্যাই বেশি। ক্রমবর্ধমান এই সংখ্যাটি ক্রমশ শহরতলি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের ড্রাগ ও অপরাধ নিবারক সংস্থা যৌথভাবে অবৈধ মাদক সেবন সংক্রান্ত বিষয় পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন পেশ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১২ থেকে ১৮ বছরের কিশোরদের মধ্যে অ্যালকোহল ২১.৪ শতাংশ, ভাং ৩ শতাংশ, আফিম ০.৭ শতাংশ এবং অন্যান্য অবৈধ ড্রাগ ৩.৬ শতাংশ সেবনের প্রবণতা দেখা গেছে। অবৈধ মাদক সেবনের এই প্রবণতা সারা দেশে এক রকম নয়। যেমন উত্তরবঙ্গে যা বেশি চলে দক্ষিণে কম আবার পূর্বে যা বেশি পশ্চিমে তা কম। তবে ফেনসিডিলের ব্যবহার দেশের সর্বত্রই বিদ্যমান।

আন্তর্জাতিক নারকোটিক্স কন্ট্রোল বোর্ডের ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, অবৈধ ড্রাগ পাচারকারীরা সরকারের দুর্বল প্রশাসনিক স্তরে আঘাত করে তাদের এই অবৈধ বাণিজ্য বেপরোয়াভাবে চালায়। ফলে স্থানীয় মানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। ড্রাগ পাচারকারীরা অর্থনৈতিক দুর্নীতির মাধ্যমে প্রশাসনকে পঙ্গু করে তোলে এবং তাদের অবাধ বাণিজ্য চালায়।

২৫ আগষ্ট  একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে,সময় ইয়াবা লুকিয়ে হাতেনাতে ধরা খেলেন মাহমুদুল হাসান নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা। তার কাছ থেকে ১ হাজার ২২ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। মামলা দায়েরের পর গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা যায়, মাদকদ্রব্যের বেশ কিছু মামলা আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার বুধবার (২৩ আগস্ট) বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চত্বরে ইয়াবা, ফেন্সিডিল, মদসহ মাদকদ্রব্য ধ্বংস করার আয়োজন করা হয়। এসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনসহ আরো কয়েকজন বিচারক উপস্থিত ছিলেন। ধ্বংস করার জন্য নিয়ে আসার আসার সময় এক প্যাকেট ইয়াবা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী প্রসিকিউটর মাহমুদুল হাসান।

এসময় তার প্যান্টের পকেট উঁচু হয়ে থাকায় সন্দেহ হয় উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেটের। এসময় উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের বলা হয় মাহমুদুল হাসানকে তল্লাশি করতে। তল্লাশি করে তার প্যান্টের পকেট থেকে এক হাজার ২২ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

সম্প্রতি উখিয়ায় ১২০ কোটি টাকার আইস জব্দ করা হয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এবার দেশের সর্ববৃহৎ আইসের চালান জব্দ হয়েছে। উখিয়ায় চালানো এ অভিযানে ২৪ কেজি ২০০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ধরা পড়ে, এ আইসের মূল্য আনুমানিক ১২০ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করেছে র‌্যাব। কক্সবাজার ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রিস্টাল মেথসহ বিভিন্ন ভয়ংকর মাদক চোরাচালান হচ্ছে এবং এ ভয়ংকর মাদকের এখন চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ বাড়ছে। ইতঃপূর্বে কক্সবাজারেও ২১ কেজি ৯০ গ্রাম আইসের চালানসহ তিন মাদক কারবারিকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এর আগে গত বছরের ২২ মার্চ আইসের চালান জব্দ করেছিল র‌্যাব। তখন মুন্সীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ১২ কেজি আইসের একটি চালান জব্দ করা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় বসে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এ আইসের সিন্ডিকেট। প্রথমদিকে সিলিকা জেলের আড়ালে আইস আনা হয়। ক্ষুদ্র দানাদার আইস দিয়ে একবার নেশা করতে অনেক টাকা লাগে। ১০ গ্রাম আইস বাংলাদেশে বিক্রি হয় প্রায় ১ লাখ টাকায়।

গত চার মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে আইস উদ্ধারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ঘটনাই বলে দিচ্ছে দেশে বিপুল পরিমাণে এ মাদক ঢুকছে। চলতি বছরের চার মাসে উদ্ধার হওয়া ৬৬ কেজি আইসের মধ্যে ৯টি চালান ছিল এক কেজির বেশি। এসব চালান ধরা পড়েছে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায়।

এর আগে ২০২০ সালে দেশে আইস উদ্ধার হয়েছিল মাত্র ৬৫ গ্রাম। তবে ২০২১ সালে আইস উদ্ধার করা হয় ৩৬ কেজি ৭৯৪ গ্রাম। আর ২০২২ সালে আইস উদ্ধার হয় ১১৩ কেজি ৩৩১ গ্রাম। জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধবিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি) বলেছে, বাজারে যত মাদক ঢোকে, তার মাত্র ১০ শতাংশ উদ্ধার করা হয়। সুতরাং, এ পরিসংখ্যান থেকেও বোঝা যায় কী পরিমাণ মাদক আমাদের দেশের তরুণরা গ্রহণ করছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, যে পথে দেশের ইয়াবার চালান ঢুকছে, সেই একই পথে ঢুকছে আইস। জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে নৌপথে নাফ নদী পেরিয়ে ৯০ শতাংশ আইস দেশে আসছে। অধিকাংশ বড় চালানই ধরা পড়েছে গত দেড় বছরে। আশির দশকের শুরুতে দেশে মাদক বলতে মূলত ছিল ফেনসিডিল। ভারত সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা দিয়ে এ মাদক দেশে ঢুকত। তবে গত এক দশকে পরিস্থিতি পালটে যায়। ফেনসিডিলের পরিবর্তে দেশে ইয়াবার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এখন আসছে আইস। সুতরাং, চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে দেশে মাদকের, বিশেষত নতুন নতুন মাদকের সরবরাহ বাড়ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অপ্রচলিত বিভিন্ন ধরনের মাদকও ধরা পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফেনইথাইলামিন, এলএসডি, ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন বা ডিএমটি, ম্যাজিক মাশরুম, খাত (ইথিওপিয়ার উঁচু ভূমিতে জন্মানো এক ধরনের উদ্ভিদের পাতা), কুশ (মারিজুয়ানা প্রজাতির গাছ), এক্সট্যাসি, হেম্প, ফেন্টানিল, মলি ও এডারল। বিদেশে এসব মাদক প্রচলিত হলেও বাংলাদেশে অপ্রচলিত। তবে নতুন এসব মাদকের প্রভাব ইয়াবার চেয়েও বেশি। গত তিন বছরে এসব মাদক বিভিন্ন দেশ থেকে নানাভাবে এ দেশে এসেছে। কোনো চালান এসেছে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে, কোনোটি বিদেশ থেকে উড়োজাহাজে কোনো যাত্রী নিয়ে এসেছেন। আবার কোনো কোনো মাদক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়েছে।
সম্প্রতি মাদক সম্পর্কিত আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মাদক ব্যবসার কারণে দেশে বছরে পাচার হয় প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড তাদের ওয়েবসাইটে অবৈধ অর্থপ্রবাহ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। পাচার করা টাকার হিসাব অনুমানভিত্তিক হিসাবে তুলে ধরেছে সংস্থাটি। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯টি দেশের মাদকসংশ্লিষ্ট অবৈধ অর্থপ্রবাহের হিসাব তুলে ধরা হয়। তথ্য বিবরণীতে আরও বলা হয়েছে, মাদকসংশ্লিষ্ট অর্থ পাচারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। আর এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। অবৈধ অর্থপ্রবাহ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে আঙ্কটাড বলেছে, মাদক ব্যবসার কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর পাচার হয় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা।

মাদকদ্রব্য অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন ও শাস্তির বিধান : হেরোইন, ফেনসিডিল, আফিম, মরফিন, নেশার ইনজেকশন, গাঁজা, ভাং, মদ, তাড়ি, ঘুমের ওষুধ ইত্যাদির উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বহন-পরিবহণ, ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে নিষিদ্ধ ও মারাত্মক অপরাধ। এসব অপরাধ দ্রুত বিচার আদালতে বিচার্য এবং এক্ষেত্রে সাধারণত জামিন দেওয়া হয় না। মাদক অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড।

মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও মাদকাসক্তি দেশের উন্নয়নে অন্যতম বাধা বলে মনে করছেন অনেকেই। তাই এ বাধা দূর করতে মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে মাদকসহ গ্রেফতারকৃতরা এবং মাদক ব্যবসায়ীরা যাতে জামিনে ছাড়া না পায়, সেজন্য নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা।  মাদকাসক্ত ও তার পরিবারের প্রতি বাড়াতে হবে সহযোগিতার হাত, তবেই বাস্তবায়ন হবে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি। কারণ, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।

মাদক-ব্যবসায়ী ও মাদক চোরাচালানকারীরা দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মাদকাসক্ত অভ্যাস নির্মূলের জন্য যুব সমাজের একটি সিদ্ধান্ত যথেষ্ট। যুব সমাজের একটি দৃপ্ত শপথই পারে তাদের মাদকের অন্ধকার থেকে ফেরাতে। মাদকাসক্ত হয়ে পৃথিবীতে কেউ কিছুই করতে পারেনি নিজেকে ধ্বংস ছাড়া। তাই আসুন মাদক মুক্ত সমাজ গঠনে সামাজিক আন্দোলন শুরু করি। মাদকমুক্ত সমাজই হোক তারণ্যের অহঙ্কার

লেখক:  সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট
মো. হায়দার আলী
প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়
সভাপতি
জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, গোদাগাড়ী উপজেলা শাখা, রাজশাহী।