ঢাকার ব্যস্ত সড়কে গাড়ির স্রোত। হঠাৎ চাপাতি হাতে তিন যুবক প্রাইভেটকারের যাত্রীর হাত থেকে মোবাইল ফোনসেট ছোঁ মেরে নিয়ে দিল ভোঁ দৌড়। ছিনতাইয়ের এ দৃশ্য মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ঘটনাটি ১৬ ডিসেম্বর আসাদগেট এলাকার। এর দু’দিন পর ঢাকার হানিফ ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীর হাতে প্রাণ হারান হাফেজ কামরুল হাসান। ছুরিকাঘাত করে টাকা ও মোবাইল ফোনসেট কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর। ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার মগবাজারে হাবিব উল্লাহ নামের এক তরুণ ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন।
রাজধানীতে এভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছিনতাই; গত পাঁচ মাসে ছিনতাইকারী নিভিয়েছে সাতজনের প্রাণ। গুরুতর জখম করা হয়েছে কয়েকজনকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ছিনতাই বেড়েছে। রাজধানীতে সক্রিয় ছিনতাইকারীর তালিকা তৈরি করছে পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিট। ওই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মিরপুর ও তেজগাঁওয়ে ছিনতাইকারীর সংখ্যা বেশি। দ্বিতীয় স্থানে আছে ওয়ারী ও মতিঝিল এলাকা। এর পর উত্তরা ও গুলশান। তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারীর মধ্যে চতুর্থ স্থানে আছে রমনা ও লালবাগ। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। রাজধানীতে ঘুরেফিরে ছিনতাই করছে, এমন সক্রিয় সদস্য ৬১৪ জন। এর বাইরে ভাসমান ও মৌসুমি ছিনতাইকারী রয়েছে কয়েকশ। রাজধানীর ছিনতাইয়ের হটস্পট আড়াইশর বেশি।
গতকাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘ইদানীং যে অপরাধটি মানুষের মধ্যে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে, সেটি ছিনতাই। ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশই মাদকাসক্ত। ১৫ থেকে ২২ বছরের ছেলেরা মাদকে আসক্ত হয়ে এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।’
র্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস সমকালকে বলেন, ছিনতাইকারীর স্পটগুলো শনাক্ত করেছি। আগে থেকে যারা ছিনতাই করে আসছে তাদের ওপর নজর রাখছি। আবার নতুনভাবে কেউ জড়িয়ে পড়েছে কিনা, সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। তবে মাদক স্পটের আশপাশে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। নৈশকোচের যাত্রীদের টার্গেট করা হচ্ছে বেশি। টহল কার্যক্রম ও তল্লাশি চৌকি জোরদার করা হয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, মামলার রেকর্ড দেখে ছিনতাইয়ের বাস্তব অবস্থা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। মূলবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার পরও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে অনেকে মামলা করেন না। ছিনতাইকারীর পেছনে সিন্ডিকেট ও পৃষ্ঠপোষক আছে। নিরাপত্তার বিষয়ে সাধারণ জনগণকে ভাবিয়ে তুলছে।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনও শতভাগ সক্রিয় হতে পারেনি। আবার যারা নতুন দায়িত্বে এসেছেন, তাদের সব কিছু বুঝে উঠতে সময় লাগছে। এ সুযোগ নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা। কোথাও তারা টার্গেট ছিনতাই করছে। তাদের হাতে অস্ত্র দেখা যাচ্ছে। জড়িত অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসছে। এর পর আবার ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে। যারা বারবার একই অপরাধ করছে, তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুপথে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৫টি। গত বছরের জানুয়ারিতে ছিনতাইয়ের মামলা ২৫, ফেব্রুয়ারিতে ২৬, মার্চে ২৮, এপ্রিলে ১৫, মে মাসে ১৯, জুনে ১৬ ও জুলাইয়ে ১৫টি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর ঝিমিয়ে পড়ে থানার কার্যক্রম। তাই এ সময়ে মামলা-জিডির পরিসংখ্যান দিয়ে অপরাধের প্রকৃত চিত্র নির্ণয় করা কঠিন।