সাম্প্রতিক সময়ে সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়াতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এতে অনেক কারখানা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। তবে শ্রমিক নেতাদের দাবি, কারখানা ভাঙচুরের সঙ্গে শ্রমিকরা জড়িত নন, বহিরাগতরা এসে কারখানা ভাঙচুর করেন। আবার অনেক সময় মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ করে দেন। অনেক কারখানায় ছুটি-বকেয়া-বেতন নিয়ে ক্ষোভ থেকে বাধ্য হয় আন্দোলনে। শ্রমিক আন্দোলনকে আরও উসকে দেয় লাগামহীন দ্রব্যমূল্য। কোনো কোনো আন্দোলনের সঙ্গে রাজনীতিও জড়িত।

রোববার (২৯ অক্টোবর) তৈরি পোশাক শিল্পখাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে শ্রম ভবনে এক আলোচনায় এসব কথা বলেন শ্রমিক নেতারা। শ্রম সচিব মো. এহছানে এলাহীর সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান।

শ্রমিক নেতারা বলেন, শ্রমিকের বেতন সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২০০ থেকে ১০ হাজার ৪০০ টাকার প্রস্তাব করেছেন মালিকপক্ষ। পাঁচ বছর পর যদি দেড় হাজার টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন মালিকেরা, তাহলে অসন্তোষ হতেই পারে। এটা অন্যতম কারণ হতে পারে সাম্প্রতিক অসন্তোষের। মাত্র দেড় হাজার টাকা বাড়ানো হলে অবশ্যই ক্ষোভ হবে। আবার মজুরি বাড়লো না এর মধ্যে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বাড়ি ভাড়া বাড়িয়েছেন মালিকরা।

তারা অভিযোগ করেন, অসন্তোষের অন্যতম কারণ রেসের ঘোড়ার মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়া। ক্রয়ক্ষমতা শ্রমিকের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। ক্রয়ক্ষমতা শুধু শ্রমিক না, সবার সাধ্যের মধ্যে রাখা উচিত। কারখানায় দুই মিনিট দেরি হলে বেতন কাটা হয়, ছুটি চাইলে দেওয়া হয় না। সুপারভাইজার শ্রমিকের গায়ে হাত তোলেন। কোনো সমস্যা হলে আগেই মালিকপক্ষ থানায় জানান, এরপর স্থানীয় পেটোয়াদের জানান। পরে শিল্প পুলিশকে জানান। সবশেষে জানানো হয় আমাদের। মনে রাখতে হবে, মালিক-শ্রমিক ও নেতা সবার সমন্বয়ে সমস্যার সমাধান হবে। সবার উপস্থিতি লাগবে, তাহলে সমাধান হবে।

শ্রমিক নেত্রী তাসলিমা আক্তার বলেন, অল্প টাকার প্রস্তাবের কারণেই শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। কারখানার মাধ্যমে শ্রমিকের রুটি-রুজি, সেক্ষেত্রে শ্রমিকরা কারখানা ভাঙচুর করতে পারেন না। এটা হলে অন্যরা সুবিধা নেবে, শ্রমিকরা জানেন সেটা। মালিকরা ব্যবসায় ভালো করছেন, আশা করি ভালো মজুরি হবে এবার। আবার আমরা যদি মনে করি শ্রমিকরা অল্প খেয়ে থাকবেন, এটা হতে পারে না। অসন্তোষ থেকেই যাবে।

শ্রমিক নেতা রানি খান বলেন, এখন যে কারখানায় ভাঙচুর, এটা শ্রমিকরা করছে না। আপনি গোয়েন্দা তথ্য নেন, ওইসব কারখানায় ১০-১২ জন লাঠি নিয়ে কারা প্রবেশ করেন। তাদের বিষয়ে নজর দেওয়া হোক। একই সঙ্গে শ্রমিকের কত মজুরি হবে সেটা পরিষ্কার করতে হবে, নাহলে মাঠে নামবে শ্রমিক। আর শ্রমিকদের মাঠে নামাতে পারে সবাই, উঠাতে কিন্ত সমস্যা হয়। আশা করছি ভালো মজুরি বাড়বে।

শ্রমিক নেতা শহিদুল্লাহ বাদল বলেন, কারা কারখানা ভাঙচুর করে আর মামলা হয় অন্যদের নামে। একটা কারখানায় ভাঙচুর হল, উপস্থিত নেই এমন একজনের নামে মামলা হয়েছে। হয়রানি ও মামলা যেন না করা হয় সেটা দেখতে হবে সরকারকে। ঘটনার দিনে হাজির নেই, ছুটিতে আছেন তিনিও মামলার আসামি কীভাবে হন?

আরেক শ্রমিক নেতা আবুল হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে রাজনীতি জড়িত। আন্দোলন থেকে রাজনীতি চলে গেলে এটাও শেষ হয়ে যাবে। তবে ন্যূনতম বেতন যাই হোক অবশ্যই বেসিক মোট বেতনের ৬৫ শতাংশ বাড়ানোর দাবি জানাই। আমাদের অধিকাংশ শ্রমিক নেতা একমত যে বেতন ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা করা হোক।

শ্রমিক নেতা মাহবুবুর রহমান বলেন, স্পর্শকাতর সময় চলছে এখন। আজ ২০২৩ সালে মজুরি নির্ধারণ হচ্ছে, যেটা কার্যকর হবে ২৪ সালে। এখন দ্রব্যমূল্য আকাশ ছোঁয়া। মজুরি না বাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। বিজিএমইএর গাফিলতিতে মজুরি নির্ধারণ দেরি হয়েছে। সম্প্রতি গাজীপুর, সাভার এলাকায় কিছু ঘটনা ঘটেছে। কিন্ত মূল ধারার কেউ এর সঙ্গে যুক্ত ছিল না। দ্রব্যমূল্যের কারণে অনেকেই রাস্তায় নেমেছে।

সাদেকুর রহমান সাদিক বলেন, গত কয়েক মাস ধরে দাবি-দাওয়া জানিয়ে আসছি। আগেই বসা উচিত ছিল। ডিজিটাল যুগে সব জানা যায়। বলা হচ্ছে এবার সবচেয়ে বেশি মজুরি হবে। মালিক-সরকার-গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বলা হয়েছে। আগেই এ নিয়ে সমাধান করা উচিত ছিল।

শ্রম সচিব মো. এহছানে এলাহী বলেন, আমরা শ্রমিকদের সব সমস্যার সমাধান করেছি। এতে আইনের ভায়োলেশন করেছি আপনাদের (শ্রমিকদের) জন্য। অনেক সময় আপনার আন্দোলন হয়, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রপ্তানিতে। আপনারা আসলে রাত ৩টার সময়ও আমরা বসি, মন্ত্রীর বাসাও ওপেন সবসময়। করোনার সময় আমি বিসিআইসির চেয়ারম্যান ছিলাম, তখনও কোনো কারখানা বন্ধ করিনি। আপনারা কারখানা যাতে বন্ধ না হয়, আপনাদের দুঃখটা বলবেন আমরা কাজ করবো। এখনো সময় আছে, ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত। আমরা এটার সমাধান পাবো আশা করছি। এ দেশ আমার, শ্রমিক আমার,আমরা যেনো অসন্তোষ না করি। সময়ের মধ্যেই মজুরি হবে। দাবি আদায়ে জানালে অবশ্যই সমাধান হবে।

প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, কারখানা ভাঙচুর করলে মালিক এক মাস পর জানতে পারে, কিন্তু শ্রমিক একদিন পরই জানতে পারেন। তাহলে কেন কারখানা ভাঙচুর হবে। ৩০ নভেম্বরের ৩০ মজুরি নির্ধারণ হবে। এতে এখনই চিন্তার কারণ নেই। এখন পর্ন্ত দুইটা প্রস্তাব এসেছে, মালিকরাও প্রস্তাব দিয়েছেন। এক মাস বাকি আছে দেখি কী হয়। আমরা মজুরি নির্ধারণ করতে না পারলে প্রধানমন্ত্রী আছেন। ভাঙচুর করে শ্রমিকের কী লাভ! এতে তাদের কিছু যায়-আসে না। এটা জানি, না কাঁদলে মাও দুধ দেয় না। তবুও আপনারা ভাঙচুর করবেন না। ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বন্ধ ছিল, সেটাও হয়েছে।

শ্রমিক নেতাদের উদ্দেশ্যে প্রতিমন্ত্রী বলেন, শুধু নেতাগিরি করলে তো হবে না। শ্রমিকের দাবি আদায় না হলে আপনি অপদস্থ হবেন। শ্রমিক যেন খালি হাতে না ফেরে। খালি হাতে শ্রমিক ফিরলে আপনাকে ভুয়া ভাববে। এ শিল্পে শান্তি বজায় রাখতে হবে, কোনো রাজনীতির সঙ্গে যেনো না জড়ায়। ট্রেড ইউনিয়ন যেন রাজনীতির সঙ্গে না জড়ায়। কোনো কোনো সংগঠন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সেটা ভিন্ন কথা। তবে গার্মেন্টস শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন যেন রাজনীতির সঙ্গে না জড়ায়। এটা শিল্পের স্বার্থে, শ্রমিকের স্বার্থে করতে হবে।