নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল হিমালয় থেকে ছুটে আসা অসংখ্য নদ-নদীর প্রবাহ   থেকে। যে প্রবাহের সাথে বহমান বিন্দু বিন্দু পলিমাটি হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে তুলেছিল পৃথিবীর বৃহত্তম এই ব-দ্বীপ। এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা সবকিছুতেই রয়েছে নদীর প্রভাব। একসময় এই নদীর বুকেই ভেসে গিয়েছে বড় বড় বানিজ্যিক জাহাজ। নদীর পাড়ে মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে তৈরী হয়েছে গান, কবিতা, উপন্যাস ও চলচ্চিত্র। মুলত তিব্বতী ভাষায় বঙ্গ অর্থ ভেজা। আবার বাংলায় বঙ্গ শব্দটি বহন এবং ভাঙ্গার সাথে জড়িত। তাই বঙ্গ একসাথে বহন করে উপরের পানি ও পলিমাটি আবার সেটা বিভিন্ন পথে ভাঙ্গনের সৃষ্টি করে। তাই এ দেশের অন্য নাম হল বঙ্গ দেশ।

তবে সেসব এখন অতীত। বাংলাদেশ এখন নদী বিপর্যয়ের দেশ। দেশের আড়াই শতাধিক ঐতিহ্যবাহী, নান্দনিক নদ নদী মরে গেছে। অনেকগুলো বেদখল হয়েছে। অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে। এভাবেই দেশের প্রায় ৯৯% নদী তাদের নাব্যতা, গভীরতা, আকার আকৃতি হারাচ্ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ। হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য।

হাজার নদীর দেশ বাংলাদেশ। এককালের পঁচিশ হাজার কিলোমিটারের জলপথের বাংলাদেশ। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। বিস্তৃত অববাহিকা ও জীবন্ত বদ্বীপ দেশটির ঐতিহ্য, সামাজিকতা, সংস্কৃতিকে নদীময় করে রেখেছে। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক ঐতিহ্য এ নদী। হাজার বছরের বাঙালিয়ানার শিকড় গ্রথিত প্রোথিত গভীরে। ঐতিহ্য বহমান নদীর স্রোতের সাথে। এ দেশের মানুষের যা–কিছু ঐতিহ্য, ঐশ্বর্য ইতিহাস, সংস্কৃতি সবকিছুতেই নদীর আশ্রয়–প্রশ্রয় বিমূর্ত। এদেশের সংস্কৃতির ভাষা, ছন্দ ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, জারি–সারি, প্রভৃতি নদীর নান্দনিকতায় ভরা। এসবে নদী প্রধান, নদী জীবন্ত, বিমূর্ত । নদীর জলে নাওয়া, গাওয়া, খাওয়া, পরিশুদ্ধি, চাষবাস এ দেশের মানুষকে প্রকৃতিবান্ধব করে, প্রকৃতির সন্তানে রূপান্তরিত করে। প্রকৃতির সাথে মিশিয়ে রাখি।
নদীর তীরে হাট–বাজার, গঞ্জ, নগর, শহর, গড়ে প্রকৃতির ছোঁয়ায় মানুষের সমাজ বিনির্মাণ ও চর্চিত হয়েছে প্রাচীন বাংলার জনপদ থেকে। এদেশের মানুষের আদি পেশা কৃষি। কৃষি এবং মৎস্য শিকারকে সমৃদ্ধ করেছে নদী এবং তার পলি ও পলল ভূমি। নদীর সাথে মানুষের দৈনন্দিন আচার–আচরণ, সংমিশ্রণ, সংশ্লেষণ বাঙালির ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বেদনায়, তাড়নায়, বিসর্জনে, বিহ্বলতায়, বিপদে–আপদে নদীর আশ্রয় গ্রহণ করেছে মানুষ। পানিতে ভাসা, হৃদয়ে জাগা অবিরাম বৃষ্টিপাত, বন্যা খরায় বিভিন্ন ঋতুতে ক্লান্ত–শ্রান্ত বাংলাদেশ। উজানের নদীবাহিত পলি, ভূমির পুষ্টি আমাদের ঐতিহ্যকে পুষ্টিবান করে। সমতল পলিপৃক্ত মাটির বুক চিরে সোহাগে বয়ে যাওয়া মায়াবী নান্দনিক নদীর দেশ, প্রীতি ও স্মৃতির দেশ বাংলাদেশ।

বাঙালির নারীর চোখের জল বাংলার নদীর জলের সাথে একাকার হয়ে সকাল–সন্ধ্যায় জীবনের সাথে প্রতিবেশের মহামিলন ঘটে এই ভূখণ্ডে। এই ভূখণ্ডে নদী ও নারী, নদী ও জীবন, নদী ও সংস্কৃতি সে কারণে অবিচ্ছেদ্য, অবিভাজিত, পরিপূরক।

নদীমাতৃক এই দেশকে, এই দেশের প্রতিবেশ–পরিবেশকে করেছে সমৃদ্ধ, ঐতিহ্যময়, বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিচিত্র এ সম্ভার পৃথিবীর আর কোথায় পাওয়া যায়! বিল–ঝিল, হাওড়–বাওর, জলাভূমি, জলমহাল, নদ–নদী, সাগর–মোহনা সবকিছুতেই প্রকৃতির সাথে বাঙালির জীবনের ছুঁয়ে যাওয়া পরশের প্রভাব বিদ্যমান। এভাবেই গড়ে উঠেছে বাঙালিয়ানার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক, সামাজিক পরিমণ্ডল, আবহ।

গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই এ দেশে নদী–ঐতিহ্যে সংকটের সূচনা হয়। নদী কমে এসেছে। বিপন্নতার ধারাবাহিকতায় নদীর সংখ্যা এখন হয়েছে সাড়ে চারশত। ৫৭ টি আন্তর্জাতিক নদীই বিপদাপন্ন। বিপদাপন্নতা এখন আন্ত ও আন্তর্জাতিক বিষয়। নাব্যতা শঙ্কা নিয়ে, দখল–দূষণ নিয়ে, অস্তিত্বের সংকট নিয়ে দেশের নদীগুলো চরমভাবে সংকটাপন্ন। দেশের আভ্যন্তরীণ নদীপথ এখন বর্ষা মৌসুমেই সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি নয়। পঁচিশ হাজার কিলোমিটার থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার!

দক্ষিণের চিত্রা, কীর্তনখোলা, ভৈরব,
রুপসা,কপোতক্ষ;
উত্তরের করোতোয়া, ইছামতি, নারোদ, বড়াল, তিস্তা, সুরমা, ব্রহ্মপুত্র, কংস, সোমেশ্বরী দূষণের দখলে দারুণভাবে সংকটাপন্ন বিপদাপন্ন। দখলদার ও ভূমি দস্যুদের দুর্দমনীয় প্রতাপে বিলীন হওয়ার পথে দেশের শতাধিক নদ–নদী।

পাবনার ইছামতি, কিশোরগঞ্জের নরসুন্দর, বগুড়ার করতোয়া, শাহজাদপুরের বড়াল, ছোট করোতোয়া, নাটোরের নারোদ, তাড়াশের বেহুলা, গাইবান্ধার ঘাঘট, রংপুরের শ্যামাসুন্দরী, নেত্রকোণার সোমেশ্বরী, কুমিল্লা গোমতী, জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী– হালদা, বাঁকখালী বিপন্নতায় বিদিশাগ্রস্ত। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ঐতিহ্য আমাদের নদ–নদী। এদের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেহ লুটপাট হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যে দূষণ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আমাদের জাগতেই হবে।

নদীর  দখলকারীদের চিহ্নিত করে বিশাল তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। পরিচ্ছন্ন প্রকৃতিবাদীরা স্বস্তি পেয়েছে, আশান্বিত হয়েছে। দেশের অনেক নদীকেই একাধিকবার আদালতের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। নদীর দেহ লুণ্ঠনকারী শকুনরা থেমে নেই। পৃথিবীর দেশে দেশে নদীকে আইনি সুরক্ষা দেয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে।

আমাদের দেশে নদীসমূহের প্রধান সংকট– দখল, দূষণ, নাব্যতা, প্রতিবন্ধকতা এবং অবৈধভাবে নদীদেহ লুন্ঠন ও সংকোচন। বালি, মাটি উত্তোলন, প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা ।

অবহেলা, নির্লিপ্ততা আমাদের অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। কর্ণফুলী আমাদের দেশের অর্থকরী প্রধান নদী।দূষণে, দখলে, উৎপীড়নে নদীটির বিপদাপন্নতা অবর্ণনীয়। আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং বহির্বাণিজ্যের শতভাগ সম্পাদন করার প্রধান মাধ্যম এটি। বিগত প্রায় এক দশক যাবত মহাখনন বা ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে নদীটির উপর যে অত্যাচার– উৎপীড়ন চালানো হয়েছে, তা অবর্ণনীয়।

তিস্তার পানি প্রবাহ এ এযাবতকালের সর্ব নিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। তিস্তা ব্যারাজ থেকে দেড়শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত নদী এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। স্রোত না থাকায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। ১৯৭৭ সালে তিস্তার উজানে গজলডোবা নামক স্থানে ভারত একটি ব্যারেজ নির্মাণ করে তিস্তার দূর্বার গতিকে থামিয়ে দেয়। ভৈরব এবং কপোতাক্ষ থেকে বের হওয়া নদীগুলো বর্ষার কয়েক মাস পানি থাকে, বাকি সময়গুলো শুকিয়ে যায়। আর নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মানুষ নদীর দু’তীরে দখল করে বসতবাড়ি-মার্কেট তৈরি করছে। পদ্মা নদীর ওপরেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ করেছিল ব্রিটিশ শাসকরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীর বোমা বর্ষণের ফলে এর কয়েকটি স্প্যান ধসে পড়েছিল।

১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। সেই নৌপথ কমতে কমতে এখন প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটারে নেমেছে। শুষ্ক মৌসুমে আরও কমে হয় ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। এ তথ্যের উত্স বিআইডব্লিউটিএর নদী সংরক্ষণ বিভাগ।ভারতের কূটনৈতিক আচরণের অভিজ্ঞতা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশ অংশে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদীর মৃত্যু ঘটবে।আমাদের দেশে আজকাল গ্রামে গ্রামে টিউবওয়েল বা চাপকল ব্যবহার করা হয় খাবার পানির জন্য, কিন্তু গ্রীষ্ম মৌসুমে অনেক কলেই পানি উঠছে না। বাংলাদেশের জন্য পানির সমস্যাটি এখন খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়।সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, নদীমাতৃক দেশ এখন মরুভূমি হতে চলেছে।আমরা এখনো সজাগ না হলে,নদী দেখতে হয় ভারত নয় বইয়ের পাতায় নদী খুজবে আমাদের পরব্তি বংশধরেরা!যে দেশের পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমেই বলা হতো নদীর কথা, যে দেশটিকে বলা হতো নদীমাতৃক দেশ, সেই নদীমাতৃক দেশেই কি না অনেক নদী শুকিয়ে গিয়ে মরুভূমির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন করছে মানুষ। এর প্রভাব পড়ছে নদীগুলোতে। এই যে নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে, এটাও তো মানুষেরই কারণে। নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। ব্যবহারের উপযোগিতা হারাতে হারাতে এখন এ পানিই মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নদীটি দেশের ব্যবসা ও অর্থকরী মাধ্যম হয়েও চরম অবহেলার শিকারে পরিণত হয়েছে। এভাবে এটি নিজেই ব্যবসার উপাদানে পরিণত হয়েছে। ভূমিদস্যুরা এর দেহ নিয়ে ব্যবসা করছে।

সংকটের স্বরূপ উদঘাটিত। প্রতিকার নিয়ে নির্লিপ্ততা, নিষ্ক্রিয়তা কিংবা আন্তরিকতার ঘাটতি, সময়োপযোগী পদক্ষেপের অনুপস্থিতি প্রকৃতি পরিবেশ এবং দেশের এই প্রাকৃতিক মূলধনের প্রবাহ নিয়ে আমরা চরমভাবে উদাসীন। আমাদের উদাসীনতা হাজার বছরের এই ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে বসেছে। নদী খোর, নদীর বালি ও মাটিখোরদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
এখনো সময় আছে, বাংলাদেশের নদীগুলোকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে। মানুষের অত্যাচারও কমাতে হবে। তা না হলে একদিন এমন সবুজ দেশটির জন্য আমাদের আফসোস করতে হবে।