মাদকের কারণে দেশে দিন দিন বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা ও খুনের ঘটনার সঙ্গে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মাদকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। মাদক সেবনের পর চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে জড়ানোর মানসিকতা সৃষ্টি হয়।
মাদকের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে যত ধরনের অপরাধ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসামি মাদক মামলার।
দেশে প্রতিবছর ৫০ হাজারের বেশি মাদক মামলা হয়। অন্য কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে এমন নজির নেই।
বিশেষজ্ঞ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।
সম্প্রতি দেশে ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক আলোচনায় এসেছে।
বিশেষ করে মাগুরার শিশু আছিয়াকে ধর্ষণ ও পরে তার মৃত্যু নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন হয়। এ ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলার প্রধান আসামি হিটু শেখ ধর্ষণের কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
গত ১২ মার্চ ঢাকার আশুলিয়ায় আট বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ১৯ বছর বয়সী এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
জানা গেছে, এই তরুণ মাদক সেবন করত।
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় ধর্ষণের ঘটনা তখন ব্যাপক আলোচনায় আসে। ধর্ষককে গ্রেপ্তারে সব বাহিনী মাঠে নামে। শেষ পর্যন্ত র্যাবের সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেপ্তার হয় ধর্ষক মজনু। ধরার পর র্যাব জানতে পারে, মজনু পুরোপুরি মাদকাসক্ত।
সে ইয়াবা ও হেরোইনের মতো মাদকে আসক্ত থাকার প্রমাণ পায় র্যাব। মজনু র্যাবের কাছে স্বীকার করে, শুধু ঢাবির ওই ছাত্রীকেই নয়, এভাবে সে আরো অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে। মজনু সেই সময় র্যাবকে জানায়, ইয়াবা সেবনের পর তার হিতাহিত জ্ঞান থাকত না।
একই সময় সিলেটে এসএমসি কলেজে স্বামীর সামনে থেকে স্ত্রীকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় হয়। এ ঘটনায় আটজন গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতে ধর্ষণের দায় স্বীকার করেছে। ওই ঘটনায়ও পুলিশ জানিয়েছিল, গ্রেপ্তাররা সবাই ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত এবং তারা মাদক সেবন করত বলেও স্বীকার করেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ইয়াবা ও হেরোইন সেবনকারীদের মধ্যে ধর্ষণের প্রবণতা বেশি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. অরূপ রতন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাদক মানুষকে ধর্ষক হতে সাহায্য করে। বিশেষ করে ইয়াবা সেবনের পর তার মনুষ্যত্ব লোপ পেতে থাকে। অন্যদিকে যৌন আকাঙ্ক্ষাও তীব্র হয়। ফলে তাদের হিতাহিত জ্ঞান না থাকায় ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়ে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাদকসেবীদেরও আমরা রোগী হিসেবে বিবেচনা করি। তাদের চিকিৎসা দরকার। এ জন্য যথাযথ রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থাকা দরকার, যেটা আমাদের দেশে নেই।’
জানা গেছে, মাদকের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে যত ধরনের অপরাধ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসামি মাদক মামলার। প্রতিবছর ৫০ হাজারের বেশি মাদক মামলা হয়। অন্য কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে এমন নজির নেই।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি ইনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মোট গ্রেপ্তার আসামির মধ্যে মাদক মামলারই বেশি।’
তাঁর কথার সত্যতা মেলে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে তিন হাজার ৬৩২টি মামলা হয় মাদকের। এই মাসে ডাকাতির মামলা ৭৪টি, দস্যুতার ১৫৩টি, খুনের মামলা ৩০০টি, দ্রুত বিচার ৮৩টি, রায়ট ১০টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের এক হাজার ৪৩০টি, অপহরণ ৭৮টি, পুলিশ অ্যাসাল্ট ৩৭টি, চুরির মামলা ৬৭৩টি, অস্ত্র মামলা ১০১টি, বিস্ফোরক মামলা ৩৭টি, চোরাচালানের মামলা ১৪৩টি।
পুলিশের তথ্যই বলে দেয়, মাদকের পরিস্থিতি কেমন দেশে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মামলা ছিল চার হাজার ৩৮৬টি। ২০২৩ সালে দেশে ৭৬ হাজার ৪০৩টি মামলা হয়। ২০২৪ সালে মামলা ছিল ৫২ হাজার ৭১৭টি।