দ্রুত সময়ে সংসদ নির্বাচন আদায় করতে চায় বিএনপি। নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্যে দেশ-বিদেশে মিত্র বাড়ানোই এখন তাদের অন্যতম কৌশল। এ পথে হাঁটতে গিয়ে তারা একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলেছে। তেমনি জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের সঙ্গেও তারা একই পথে নেই।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ, রাষ্ট্রপতির অপসারণ, সংবিধান বাতিলসহ অনেক ইস্যুতেই ছাত্র নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের দ্বিমত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে প্রতিবেশী দেশসহ পশ্চিমা বিশ্বের উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে। একসময়ে দেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী উচ্চকিত থাকা দলটির নেতারা এখন অনেকটাই সুর পরিবর্তন করেছেন। যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, সংস্কার, নির্বাচন ও ঐক্য– এই তিন বিষয়ে প্রাধান্য দিয়েই আগামীতে তাদের পথচলার কৌশল নির্ধারণ করতে চান। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদারদের সঙ্গেই সখ্য বাড়াতে তৎপর শীর্ষ নেতৃত্ব। ফলে অনেক ইস্যুতে দলটি সব পথেই হাঁটছে।
সূত্রগুলো বলছে, বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর মনোভাব আঁচ করতে পেরেই বিএনপি সংবিধান বাতিলে ছাত্রনেতাদের দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত একাধিক পশ্চিমা কূটনীতিকের পক্ষ থেকেও বিএনপির এ অবস্থানকে সমর্থন জানানো হয়েছে। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও এ মুহূর্তে সংবিধান বাতিলের মতো সিদ্ধান্তের পক্ষে নন। কারণ, এতে রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন করে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা রয়েছে। বিএনপিও মনে করছে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। এর মধ্যে নতুন কোনো জটিলতা তৈরি হলে নির্বাচন আরও পিছিয়ে যেতে পারে। বিএনপির এসব তৎপরতার প্রতি ইঙ্গিত করেই ছাত্রনেতারা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা ঠেকাতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদারদের সঙ্গেই সখ্য বাড়াতে তৎপর বিএনপি। ২০১৮ সালে একাদশ এবং বিদায়ী বছরে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে অসংখ্য ছোট-বড় দলের ভিড় ছিল। বর্তমানে দলটি কোনো জোটের নেতৃত্বে নেই। সমমনা বেশ কিছু জোট ও দলের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া রয়েছে। যদিও এর পেছনে রয়েছে আসনকেন্দ্রিক সমঝোতা।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে শহীদ মিনার থেকে গত মঙ্গলবার ঘোষণাপত্র পাঠের কর্মসূচি যে বিএনপি ইতিবাচকভাবে নেয়নি, তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ছাত্রদের এই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি বাদ দেওয়ার জন্য সরকারকে এক ধরনের বার্তাও দেওয়া হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। এমনকি আগের দিন সোমবার রাতে এই বিষয়টি নিয়ে ছাত্রদের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে লন্ডন থেকে টেলিফোনে কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর পরই দফায় দফায় বৈঠক করে ছাত্ররা এই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি স্থগিত করে। অন্যদিকে একই সময়ে ঢাকায় গুলশান অফিসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকেও ছাত্রদের এই কর্মসূচির চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতে থাকে। রাত সাড়ে ১০টায় দলটি যখন বৈঠক শেষ করে তার আগেই ছাত্রনেতাদের কাছে কর্মসূচি বাতিলের বার্তা পৌঁছে যায়। পরে অবশ্য ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি দিয়ে মুখ রক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা।
এসব বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, আমরা নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছি। নির্বাচন
হলে সংকট অনেকাংশে কমে আসবে। নির্বাচিত সরকারে মানুষের যে আস্থা, সেই সঙ্গে নির্বাচিত সরকারের যে শক্তি তৈরি হয়, সেটা অনেক শক্তিশালী হয়। যে কারণে তারা অনেক কাজ করতে পারেন, যা অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ জন্য আমরা এ বছরেই নির্বাচন চাই।
বিএনপি নেতারা জানান, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে বিগত ১৭ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন তারা। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করা হয়। তবে এখনও স্বস্তি মিলছে না, দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসেনি। দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফিরে আসেনি। সেখানেও নানা বাধা-বিপত্তি আর প্রতিবন্ধকতা। একের পর এক ইস্যু সৃষ্টি করে নির্বাচনকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তারা বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির মধ্যে শুরু হয়েছে স্পষ্টত বিভক্তি। এতে বিপ্লবের মূল চেতনা বেহাত হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের। বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতেও শুরু হয়েছে নানামুখী তৎপরতা। দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়েও সন্দিহান দলটির নেতারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতাদের ওপর ভর করে একের পর এক ইস্যু সৃষ্টির পেছনে এই দলটির হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন তারা। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াত দ্বৈত ভূমিকা রাখছে। প্রকাশ্যে একরকম বললেও গোপনে অন্য খেলায় লিপ্ত রয়েছে বলে সন্দেহ দলটির।
আবার ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনের ফসল অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গেও বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধিতা চলছে বিএনপি ও তার মিত্রদের। সংস্কার আগে, নাকি নির্বাচন আগে– এ নিয়েই মূলত দূরত্ব বাড়ছে। বিএনপি এবং এর মিত্র দল ও জোটগুলোর বেশির ভাগই প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে দ্রুত নির্বাচন চাইছে। তবে ছাত্র নেতৃত্ব সার্বিক সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের কথা বলছে। এ নিয়ে চলছে দোষারোপের খেলা।
তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, সংস্কারে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এটা চলমান প্রক্রিয়া। অভ্যুত্থানের দুই বছর আগে তারা রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা দিয়েছেন। ওই সংস্কারের মাধ্যমেই দেশকে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করা সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কারের কথা বলছে, তার সবগুলোই ওই ৩১ দফাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই এখন প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছে দলটি। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন-সংক্রান্ত সংস্কারকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য সরকারকে বলছে বিএনপি।
এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই সংস্কার কখনও থেমে থাকে না। নির্বাচন হওয়ার আগে অত্যাবশ্যকীয় যে সংস্কারগুলো রয়েছে প্রশাসনিক সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, নির্বাচন কমিশন সংস্কার একটি সমন্বয়ের মাধ্যমে হবে। পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলবে এবং শিগগির সেই নির্বাচনের আয়োজনও করতে হবে জনগণের ভোটাধিকারের জন্য।
জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিরোধ থাকলেও আপাতত কোনো বিরোধিতায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত বদলের কৌশলও রয়েছে তাদের। প্রয়োজনে আবারও রাজপথে নামার কথা বলছেন তারা। এরই মধ্যে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দলটির নেতারা বলতে শুরু করেছেন– আবারও ৫ আগস্টের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, এ মুহূর্তে কারও সঙ্গে বিরোধে যেতে চাই না। আমি মনে করি, এখন যেটা দরকার– সব বিষয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটি আমাদের একটি দায়িত্ব। সেভাবেই আমরা কাজ করতে চাই।
দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য বলেন, নির্বাচন দেরিতে করার জন্য একটি অংশ এখনও ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপি মনে করছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের ওপর ভর করে একটি চক্র গত অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবি তুলেছিল। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের মাধ্যমে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করে তারা আসলে কী করতে চায়, এ নিয়ে ওই সময়ই সন্দেহ তৈরি হয় বিএনপিতে। প্রকাশ্যে সেই দাবির বিরোধিতা করেছিলেন তারা। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের অবস্থানের কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দাবি থেকে সরে আসতে হয়।
সর্বশেষ ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েও বিএনপি নেতৃত্ব অসন্তুষ্ট। সেখানেও বিএনপির বিরোধিতায় আপাতত সেই ইস্যু থেকে সরে এসেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতারা। নিকট ভবিষ্যতে চক্রটি আরও চক্রান্ত করতে পারে বলেও সন্দেহ তাদের। এর মধ্যে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের ইস্যু সৃষ্টি করেও বিভক্তির চেষ্টা হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না, জনমতকে উপেক্ষা করে তারা কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না বলে বিশ্বাস করছেন বিএনপির হাইকমান্ড।
বিএনপির মূল্যায়ন হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের পেছনে কারা, কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা এসব কর্মকাণ্ড করছে, তা বের করতে কাজ করছেন তারা। এখন পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনের এসব উদ্যোগের দৃশ্যমান কোনো পৃষ্ঠপোষক তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। ছাত্রদের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা নেই; জামায়াতে ইসলামী জড়িত কিনা, সেটাও তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে দেশে এই যে একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা, সেটা আওয়ামী লীগকে মাইনাস করার পর বিএনপিকেও মাইনাস করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করছে দলটি।
নির্বাচন নিয়ে বাইরের বাদানুবাদের মধ্যে নিজ ঘরেও নানা চ্যালেঞ্জ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বিএনপিকে। নেতাকর্মীরা জানান, ক্ষমতায় চলে আসছেন মনে করে দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সুবিধাবাদীরাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পুরো দলকে কাঠগড়ায় নিয়ে যাচ্ছে তারা। দলের হাইকমান্ডের কঠোর হুঁশিয়ারি, সাংগঠনিক ব্যবস্থার মধ্যেও হাইব্রিড নেতাদের দাপট ক্রমেই বাড়ছে। তাদের চাপে দূরে সরে যাচ্ছেন দীর্ঘদিনের ত্যাগী, নির্যাতিত আর যোগ্যরা। এখনই তাদের থামাতে না পারলে জনমত অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। এ জন্য নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠের নেতাকর্মীকে ব্যতিব্যস্ত রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছে। এতে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে যেমন গতিশীলতা আসবে, তেমনি জনমতকেও নিজেদের পক্ষে রাখা যাবে বলে বলে মনে করা হচ্ছে।