জনগণের নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই গ্রহণযোগ্য সংস্কার সম্ভব বলে মনে করছে বিএনপি। দলটি বলছে, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র, জনগণের মালিকানার প্রতিফলন হয় নির্বাচিত সংসদ এবং জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

শনিবার (২২ মার্চ) বেলা ১১টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়।

এতে দেশের চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরে নির্বাচন, জাতীয় ঐক্য ও সংস্কার ইস্যু নিয়ে কথা বলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কার প্রস্তাবগুলোর সাংবিধানিক ও আইনগত ভিত্তি প্রদানের জন্য একটি নির্বাচিত সংসদই কেবল উপযুক্ত ফোরাম। বিদ্যমান ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য এই দেশ ও দেশের মানুষের মূল চালিকাশক্তি। এই ঐক্য ও দেশকে এগিয়ে নিতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।

এই ঐক্যকে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে হবে। আমরা এমন কোন পদক্ষেপ নিতে পারি না যাতে এই ঐক্য বিনষ্ট হয়। সুতারং অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার অবস্থান বজায় রাখতে হবে। কোনো মহলকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এজেন্ডা যেন সরকারের কর্মপরিকল্পনার অংশ না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, সংস্কারের উদ্দেশ্য হলো জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা এবং জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান করা। সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করা। ‘নির্বাচন আগে সংস্কার পরে’ কিংবা ‘সংস্কার আগে নির্বাচন পরে’ এমন অনাবশ্যক বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। যেহেতু সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, সংস্কার এবং নির্বাচন একসঙ্গে চলতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি চার্টার অব রিফর্ম-সংস্কার সনদ তৈরি হতেই পারে।

নির্বাচিত সরকার পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন করবে। এমন অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয় হল একটি সুষ্ঠু অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত একটি অবাধ নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। নির্বাচিত সরকার জনগণের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সমূহ সম্পন্ন করবে। জনগণের নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই গ্রহণযোগ্য সংস্কার সম্ভব।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কোন কোন উপদেষ্টা ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করার নানা প্রকার লক্ষণ ও প্রমাণ ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে যা দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মোটেই সুখকর নয়।

তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো যে বিষয়গুলো প্রস্তবাকারে আসতে পারতো তা প্রস্তাব না রেখে প্রশ্ন আকারে হ্যাঁ, না, উত্তর দিতে বলা হয়েছে। যেমন, প্রস্তাবগুলো গণপরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন চাই কি না? হ্যাঁ অথবা না বলুন। কিন্তু প্রথমে সিদ্ধান্ত আসতে হবে যে, গণপরিষদের প্রস্তাবে আমরা একমত কিনা? একইভাবে ‘গণভোট’, ‘গণপরিষদ এবং আইন সভা’ হিসাবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন চাই কিনা ইত্যাদি হ্যাঁ না বলুন। সংবিধানের ‘প্রস্তাবনার’ মত অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশে থাকলেও তা স্প্রেডশিটে উল্লেখ করা হয়নি। স্প্রেডশিটে ৭০টির মত প্রস্তাব উল্লেখ করা হলেও মূল প্রতিবেদনে সুপারিশ সংখ্যা প্রায় ১২৩টির মত। একইভাবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মূল প্রতিবেদনে ১৫০টির মত সুপারিশ তুলে ধরা হলেও স্প্রেডশিটে মাত্র ২৭টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশই সংবিধান সংস্কারের সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই আমরা মনে করছি— স্প্রেডশিটের সাথে মূল সুপারিশমালার ওপর আমাদের মতামত সংযুক্ত করে দিলে বিভ্রান্তি এড়ানো যাবে।

তিনি আরো বলেন, সুপারিশমালা সমূহ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে এতে ভবিষ্যতে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োগের অযৌক্তিক প্রচেষ্টা রয়েছে যা অনভিপ্রেত। সুপারিশমালায় সাংবিধানিক কমিশনসহ (এনসিসি) নতুন নতুন বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সমস্ত কমিশনের এখতিয়ার, কর্মকাণ্ডের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে যতটা সম্ভব অবমূল্যায়ন করা এবং ক্ষমতাহীন করাই উদ্দেশ্য, যার ফলশ্রুতিতে একটি দুর্বল ও প্রায় অকার্যকর সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র, জনগণের মালিকানার প্রতিফলন হয় নির্বাচিত সংসদ এবং জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। কিন্তু সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সমূহ পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, রাজনীতিবিদরা অপাংতেয় এবং অনির্বাচিত লোকদেরই দেশ পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করাই শ্রেয়। জনগণের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি ও ধর্মবোধ এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়েই বিভিন্ন সংস্কার ও সাংবিধানিক সংশোধনী প্রণীত হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করছে বিএনপি।

তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যকে সমুন্নত রেখে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই বর্তমান সময়ের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বৃহত্তর জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সকল সংস্কার প্রচেষ্টা পরিচালিত হবে এটাই জাতীয় প্রত্যাশা।