মোঃ হায়দার আলীঃ ব্যাপক হারে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয় সম্পর্কে এখন আর কারো দ্বিমত নেই। দেশের পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবী এবং ঢাকা শহরের চারপাশের নদ-নদী দূষণ, সামান্য বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ার মত বাস্তব সংকটের প্রেক্ষাপটে বিগত সরকার আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেও আইনের বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার কারণে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। বর্তমান সরকার আগামী ১ অক্টোবর থেকে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেতে যাচ্ছে। এটা একটি সময় উপযোগী, বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ। এর জন্য প্রশাংসা পাচ্ছেন বর্তমান সরকার।
আমাদের নাগরিক জীবনে পলিথিন ব্যাগ যেমন একটি অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, পাশাপাশি পলিথিন ব্যাগের কারণে সৃষ্ট পরিবেশ ও প্রতিবেশগত প্রতিক্রিয়া আমাদের নগরব্যবস্থাকে একটি অনিবার্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আশির দশক থেকেই দেশের পরিবেশবাদীরা অপচনশীল এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সৃষ্টিকারী পণ্য হিসেবে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কাছে জোর দাবী জানিয়ে আসছিল। বিশেষত ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর ঢাকা শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ার জন্য কোটি কোটি পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যাগের জমাটবদ্ধতাকে দায়ী করা হয়। সেই থেকে ঢাকার পানিবদ্ধতা, নদীদূষণসহ পরিবেশগত সংকট মোকাবেলায় পলিথিন ব্যাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, দেশের প্রতিটি বিভাগীয়, জেলাশহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পর্যন্ত পলিথিন ব্যাগের ব্যাপক ব্যবহার পানিদূষণ, মাটিদূষণসহ নানা ধরনের পরিবেশগত হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিগত চারদলীয় জোট সরকার ২০০২ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অবৈধভাবে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, আমদানী ও বিপণনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে বিধান রেখে আইন পাস করা হয়। আর নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রদর্শন, সংরক্ষণ ও গুদামজাত করার অপরাধে ৬ মাসের কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়। কঠোর আইন প্রণয়নের সাথে সাথে সে সময়ের পরিবেশমন্ত্রী নিজেও পলিথিন বিরোধী অভিযানে মাঠে নেমেছিলেন। একই সাথে পাটের ব্যাগ বাজারজাতকরণ এবং পলিথিন শিল্পের সাথে জড়িতদের পুনর্বাসনের ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি পলিথিনের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান পরিচালনার ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরে পলিথিনের ব্যবহার অনেকটা কমে এসেছিল। তবে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে এবং ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের সময় থেকে পলিথিন বিরোধী পদক্ষেপ অকার্যকর হয়ে পড়তে শুরু করায় পতিত শেখ হাসিনা সরকার আমূলে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকার কারণে অব্যাহতভাবে এর ব্যবহার বাড়তে থাকে।
নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব রাজধানীসহ পুরোদেশ। যত্রতত্র ব্যবহারের কারণে চাহিদা বেড়েছে, বেড়েছে উৎপাদনও। ঢাকার উৎপাদিত পলিথিন দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভারতেও পাচার হচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের তথ্য মতে, দেশে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ টন পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। বাস্তবে এর পরিমাণ আরও বেশি হবে। বিগত ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, প্রশাসনের নাকের ডগায় দেদারছে পলিথিন উৎপাদন ও সরবরাহ করা হয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ১ অক্টোবর থেকে শপিং মলগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। প্রাথমিকভাবে সরকারের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে ধীরে ধীরে পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনলে চাহিদা কমে যাবে। তাতে উৎপাদনও হ্রাস পেতে বাধ্য। উল্লেখ্য, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের পর ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাজারে পলিথিন ব্যাগ ছিল না। তখন পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগের প্রচলন শুরু হয়। তাতে পাট শিল্পের অনেক উন্নতি হয়েছিল।
উৎপাদন, বিপনন, ব্যবহার নিষিদ্ধ; অথচ সবার হাতে হাতে পলিথিন। নিত্যদিনের বাজার সদাই মানেই পলিথিনের ব্যবহার। নিষিদ্ধ পলিথিনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবেশের। ঢাকা শহর এখন বিশ্বের এক নম্বর বায়ূ দুষণের শহর। দোকানে আইন শৃংখলা বাহিনীর চোখের সামনে পলিথিনের স্তুপ, আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতেও শোভা পায় পলিথিনের ব্যাগ: অথচ আইন করে সর্বনাশা পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক পলিথিন উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও অবাধে চলছে পলিথিনের উৎপাদন ও বিপনন প্রক্রিয়া। দৈনন্দিন জীবনের সব কাছে চলছে পলিথিনের ব্যবহার। নিত্যদিনের বাজার সদাই থেকে শুরু করে এক টাকা দামের চকলেট হোক বা লাখ টাকার ফ্রিজ সব কিছুর সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে পলিথিন। এসব পলিথিন ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অপচনশীল পলিথিনে ভরাট হচ্ছে পয়োনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা। আর তাতে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ধূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ পলিথিন অপচনশীল হওয়ায় ফসলের জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় কারণে আবাদী জমির হিউমাস নষ্ট করে উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাপকহারে হ্রাস পাচ্ছে। পলিথিন নষ্ট করছে মাটির গুণাগুণ। পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্যে পুকুর বিল, নদী থেকে সাগরের পানি পর্যন্ত দূষিত হচ্ছে। ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশে নিষিদ্ধ এই পলিথিনের উৎপাদন চলছে অনেকটা নির্বিঘ্নে। পুরান ঢাকার ইসলামবাগ, যাত্রাবাড়ি, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় পলিথিন কারখানা আছে ভুরি ভুরি। মাঝে মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর বা বিভিন্ন সংস্থার ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও ক’দিন যেতে না যেতেই আবার স্বাভাবিকভাবেই সেসব কারখানা আবার চালু হয়।
সর্বনাশা এই পলিথিন বা প্লাস্টিক (একবার ব্যবহার যোগ্য) সামগ্রী এক বছরের মধ্যে বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি সম্প্রতি সর্বনাশা পলিথিনের ব্যবপক ব্যাবহারের ফলে পরিবেশের যে মারাত্মক দূষন হচ্ছে তা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পরিবেশের বিষ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের কার্যক্রম আরও জোরদার এবং প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি করে রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানির ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর সে আলোকে কাজ করছে। পলিথিন উৎপাদন ও বিপননের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান সারা দেশে অব্যাহত রয়েছে। অভিযানের পাশাপাশি এ বিষয়ে জনসচেতনা বৃদ্ধির কার্যক্রমও শুরু হচ্ছে।
সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী আরো অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ১ হাজার ৩৪৭টি কারখানায় এ নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর সিংহভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, অনেক দেশে তা ১০ মাসেও হয় না। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার দ্বিতীয় বারের মতো ১৭টি পণ্যের মোড়কে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। এর পরেও বিভিন্ন সময় ধাপে ধাপে পলিথিনবিরোধী অভিযান ও নিষিদ্ধ পলিথিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিপুল পরিমাণ পলিথিন জব্দ করেন। পরিবেশ বিপন্নকারী সর্বনাশা পলিথিন ব্যবহার নিরসনকল্পে পলিথিনের ব্যবহার সীমিতকরণ, বিকল্প পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি পলিথিনের ক্ষতিকর দিক থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এলাকার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারখানার মেশিন প্রতি পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে মাসে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছে তারা। অভিযোগ রয়েছে, মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পলিথিনবিরোধী যে অভিযান চালায় তাতে চাঁদা না দেয়ার বিষয়টি জড়িয়ে আছে। যেসব কারখানা চাঁদা দেয় না শুধু তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়। দেখা যাচ্ছে, পলিথিনের রমরমা কারবার চলছে পরিবেশ অধিদফতর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের যোগসাজসে।
উন্নত বিশ্বের কোথাও এভাবে পলিথিন ব্যবহার করা হয় না। পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এ উপকরণ অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। আমাদের দেশে আইন করে নিষিদ্ধ হলেও তা মানা হচ্ছে না। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই পলিথিনের শত শত কারখানা বহাল তবিয়তে রয়েছে। আইন অমান্যের এমন নজির কোথাও আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। পলিথিন এমনই এক উপকরণ যে, তা পচে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিথিনের তৈরি একটি ব্যাগ পচতে বা নিঃশেষ হতে ৪০০ বছর লাগবে। এই পলিথিন যেখানে পড়ে থাকে সেখানের মাটির উর্বরতা থাকে না। কোনো গাছপালা ও ফসল উৎপাদিত হয় না।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন এক রাজধানীতেই দেড় কোটি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেয়া হয়। বড় বড় শপিং সেন্টার, মার্কেট, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে পাড়ামহল্লার মুদি দোকান ও রেস্টুরেন্টে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ব্যাগ যত্রতত্র ফেলার ফলে তা নর্দমা ও ড্রেনে পড়ে পুরো ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো করে দিচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে, ভয়াবহ পানিবদ্ধতা। পলিথিন গিয়ে পড়ছে নদী-নালা, খাল-বিলে। এতে নদীদূষণের পাশাপাশি সাগরের পরিবেশ ও প্রতিবেশ দূষিত করছে। রাজধানীর প্রাণ হিসেবে খ্যাত বুড়িগঙ্গার দূষণ ও নাব্য হারানোর অন্যতম মূল কারণ এই পলিথিন। কয়েক বছর আগে নাব্য ফেরাতে ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নিয়েও তা সফল হয়নি শুধু পলিথিনের কারণে। তখন বলা হয়েছিল, বুড়িগঙ্গার তলদেশে প্রায় ছয় ফুট পলিথিনের স্তর রয়েছে। এই স্তর সরিয়ে ড্রেজিং করা সম্ভব নয়। ফলে ড্রেজিং অসমাপ্ত রয়ে যায়।
শুধু বুড়িগঙ্গাই নয়, রাজধানীর চারপাশের নদী-নালা এবং জেলা শহরের আশপাশের নদ-নদী অচল হয়ে পড়ছে পলিথিনের কারণে। অক্ষয় এই উপকরণটি পুরো পরিবেশকে এক বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। হাটে-মাঠে, ঘাটে, পর্যটন কেন্দ্রসহ এমন কোনো স্থান নেই যেখানে পলিথিন পরিবেশ দূষণ করছে না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, পরিবেশ অধিদফতরসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জ্ঞাতসারে শত শত পলিথিন কারখানা গড়ে উঠলেও তা বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বরং এসব অবৈধ কারখানাকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বাণিজ্য এবং উদাসীনতার কারণে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে পলিথিন কারখানা। পলিথিন যে পরিবেশ দূষণ করছে তা নয়, ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের জ্বালানিও হয়ে রয়েছে। পুরনো ঢাকায় যেসব ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছে সেগুলোর আগুন ছড়িয়ে দিতে পলিথিনের ভূমিকাও রয়েছে।
দেশের পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে ফুটপাতের দোকানগুলোতেও দেদারছে ব্যবহার করা হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, মাছ, গোশত থেকে শুরু করে সবজি এমনকি তরল দুধ ও তেল বিক্রিতেও পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। শুধু বাজারই নয়, শপিংমলসহ অলিতে-গলিতে থাকা দোকানগুলোতে দেদারছে পণ্যের সাথে ব্যবহার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যাগ। ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকার। কমেছিল পলিথিনের ব্যবহারও। কিন্তু, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহারকে অলিখিতভাবে বৈধতা দেয়। পুরান ঢাকার যে সব ব্যবসায়ি আগে গোপনে প্লাস্টিকের আড়ালে পলিথিন উৎপাদন করতো তারা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সাথে আঁতাত করে প্রকাশ্যেই উৎপাদন শুরু করে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থেকে শুরু করে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সব ধরনের কর্মকর্তা এবং পুলিশকে মাসোহারা দিতে হতো বলে ব্যবসায়িরা জানায়। ব্যবসায়িদের ভাষ্য, দেশের চাহিদা পূরণ করে কয়েক বছর ধরে ভারতেও পাচার হচ্ছে পলিথিন। সেখানে পলিথিনের ব্যাপক চাহিদা থাকায় চোরাইপথে পাচার করে আওয়ামী লীগের নেতারা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছেন।
এদিকে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো পলিথিন শপিং ব্যাগ ও পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদেরকে দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা এর সম্মুখে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের ক্রয়ের জন্য রাখা হবে। এখানে তরুণ বা শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা হবে। তিনি বলেন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ১ অক্টোবর থেকে শপিং ব্যাগ পরিহারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার হবে। পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। গত ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের সাথে অনুষ্ঠিত সভায় তার বক্তব্যে পরিবেশ উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের মধ্যে সকল সুপারশপের সঙ্গে সভা করে পাটের শপিং ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরিবেশ অধিদপ্তর ইএসডিও›র সঙ্গে মিলে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি পাট বা বস্ত্রের ব্যাগের উৎপাদনকারীদের নিয়ে একটি মেলার আয়োজন করবে। মেলায় সুপার শপের কর্তৃপক্ষ এবং উৎপাদনকারীরা নিজেদের চাহিদা এবং সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে। তাই এখনই প্রয়োজন নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার কঠোরভাবে বন্ধ করা। এর উৎপাদন থেকে শুরু করে ব্যবহারকারী পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। অবৈধ পলিথিন কারখানা সিলগালা করতে হবে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে কাগজ বা পাটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা গেলে হয়তো পাটকলগুলোকে রক্ষা করা যাবে। পলিথিন ও প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদনের যথার্থতা নিরূপণ ও নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও কঠোর হতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে এর পুনর্ব্যবহার ও রিসাইক্লিংসহ সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই হয়তো আমরা একটা নিরাপদ বাসস্থান রেখে যেতে পারব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। পরিবেশ বিপন্নকারী সর্বনাশা পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করে বিকল্প পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি পলিথিনের ক্ষতিকর দিক থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে জনসচেতনতার বিকল্প নেই।