শরীয়তপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে দালালদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এতে দিনদিন সেবাপ্রার্থীদের সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, দালালের সহায়তা ছাড়া পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা হলে নানা কারণ দেখিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের। অথচ দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত ফি দিলেই খুব দ্রুত হয়ে যাচ্ছে কাজ।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শরীয়তপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের সামনের সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে ৪-৫টি দোকান। এসব দোকানে কম্পিউটারের মাধ্যমে পাসপোর্টের ফরম পূরণ করা হয়। এছাড়া শহরের জজ কোর্ট এলাকা ও চৌরঙ্গীর বটতলা মাদরাসা গেট এলাকায় রয়েছে কমপক্ষে ২০টি দোকান। এসব কম্পিউটারের দোকান থেকে আবেদন করার সময়ে মূলত দালালদের খপ্পরে পড়ে থাকেন আবেদনকারীরা। এখান থেকেই দালালরা পাসপোর্ট করার জন্য আবেদন ও ব্যাংক ড্রাফট করে দেন সেবাপ্রার্থীর।

সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, দালাল ছাড়া নিজে নিজে আবেদনপত্র নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে গেলে আবেদনপত্রে ত্রুটি ধরে সেটি সংশোধন করার জন্য বারবার ফেরত পাঠানো হয়। এভাবে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। শেষে এক প্রকার বাধ্য হয়েই চুক্তিবদ্ধ হয়ে দালালদের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেন ভুক্তভোগীরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলা শহরের পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দালাল রয়েছে। তাদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের কিছু কর্মকর্তার যোগাযোগ রয়েছে। এসব কর্মকর্তার হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমোতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও বিকাশে টাকা পাঠান তারা। পরে অফিস থেকে নির্ধারিত তারিখ জানানো হলে অফিসে এসে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে যান আবেদনকারীরা। এসব দালালরা প্রতিটি পাসপোর্ট ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য ৪-৫ হাজার ও নাম সংশোধনের জন্য ১০-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন। প্রতিটি পাসপোর্টের জন্য পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাকে দেন এক হাজার করে।

জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয় সূত্র জানায়, এ কার্যালয় থেকে সাধারণত পাঁচ বছর ও ১০ বছর মেয়াদি দুধরনের পাসপোর্ট করানো হয়। একটি সাধারণ ও অন্যটি জরুরি। ৪৮ পৃষ্ঠার পাঁচ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সরকারি ফি ৪ হাজার ২৫ টাকা ও জরুরি ফি ৬ হাজার ৩২৫ টাকা। এছাড়া ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট করার জন্য সাধারণ ফি ৫ হাজার ৭৫০ টাকা ও জরুরি ফি ৮ হাজার ৫০ টাকার প্রয়োজন হয়।

সোমবার (২ অক্টোবর) সকালে নতুন পাসপোর্টের আবেদন করার জন্য গোসাইরহাট থেকে পাসপোর্ট অফিসে আসেন রাজিব হোসেন নামের এক ব্যক্তি। অফিসের এক কর্মকর্তার কাছে আবেদনপত্রটি জমা দেওয়ার পর সেটি ভুল দেখিয়ে সংশোধন করে আনার জন্য ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

রাজিব হোসেন বলেন, “আমার ফাইলটি সম্পূর্ণ ওকে ছিল। আমি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্রসহ সবধরনের কাগজপত্র দিয়েছি। কিন্তু জমা দেওয়ার পর আমার ফাইলটি দিয়ে কাজ হবে না বলে ‘রিজেক্ট’ করে দেয় এক অফিসার। পরে ওই ফাইলটিই এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ১৫০০ টাকার বিনিময়ে করিয়ে আনলে ওনারা আমার কাজটি করে দেয়।”

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আগে জানতাম যাদের ফাইল ওকে থাকে তাদের নাকি লিগ্যালি করে দেয় তারা। কিন্তু এখানে আসার পর দেখলাম কোনো কিছুই দালাল বা টাকা ছাড়া হয় না!’

শুধু রাজিব হোসেন নয়, এখানে পাসপোর্ট করাতে আসা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে দালালদের শক্ত সিন্ডিকেটের কথা উঠে এসেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঝামেলা এড়াতে বাধ্য হয়েই তারা দালালদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পাসপোর্টের কাজ করিয়ে নিচ্ছেন।

পুরোনো পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় একই দিনে (সোমবার দুপুর) নতুন পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে নড়িয়া উপজেলায় থেকে আসেন সেলিম শিকদার নামের এক ব্যক্তি। এরআগে বেশ কয়েকবার জাতীয় পরিচয়পত্র ও পুরোনো পাসপোর্টের কপি জমা দিয়ে নতুন পাসপোর্ট পেয়েছেন। অথচ এবার পাসপোর্ট অফিসে গেলে তাকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ভেরিফাইড কপি আনতে বলা হচ্ছে।

সেলিম শিকদার বলেন, ‘আমার যেহেতু আগে থেকেই ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া আছে তাহলে সার্চ দিলেই তো আমার পরিচয়পত্র আসলো কি না বের হয়ে আসবে। তাহলে শুধু শুধু আমাকে কেন এমন হয়রানি করা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমরা এসব হয়রানি থেকে প্রতিকার চাই।’

নড়িয়া উপজেলার ধামারন থেকে আসা মজনু খালাসী জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরোনো পাসপোর্ট রিনিউ করতে এসেছিলাম। আবেদনপত্রের সঙ্গে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, কারেন্ট বিলের ফটোকপি ও কাবিননামার ফটোকপি দিয়েছি। এসব কিছু দেওয়ার পরেও কাবিননামার আসল কপিটি জমা না দেওয়ার কারণ দেখিয়ে আমার আবেদনপত্রটি ফেরত দেওয়া হয়েছে।

কলি বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘পাসপোর্ট রিনিউ করতে আসার পরে থেকে এই পেপার সেই পেপার লাগবে বলে হয়রানি করা হচ্ছে। এখন তো মনে হচ্ছে দালালের মাধ্যম ছাড়া এসেছি বলে আমাদের এভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তারাই বলে দালাল ছাড়া আসবেন না। কিন্তু দালাল ধরে আসলেই ভালো হতো, এতো হয়রানি হওয়া লাগতো না।’

দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করাতে ভেদরগঞ্জ উপজেলার সাজনপুর থেকে এসেছেন কাউসার আহমেদ। কাউসার জানান, রাজন নামের এক ব্যক্তি সাজনপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধনের কাজ করেন। তার মাধ্যমে সাড়ে ৮ হাজার টাকা চুক্তির বিনিময়ে তিনি পাসপোর্ট করাতে এসেছেন। ওই টাকার মধ্যেই রাজন পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু করে দেবেন বলে জানিয়েছেন।

পরে নাম-পরিচয় গোপন রেখে রাজন নামের ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তার সঙ্গে পাসপোর্ট করানোর বিষয়ে কথা হয়। রাজন বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ১০ বছরের সাধারণ পাসপোর্ট করাতে হলে পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ ৯ হাজার ও জরুরি পাসপোর্টের জন্য সাড়ে ১১ হাজার টাকা দিতে হয়। আর পাঁচ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্ট করাতে গেলে সাত হাজার ও জরুরি পাসপোর্টের জন্য সাড়ে ৯ হাজার টাকা দিতে হয়। তবে আপনি যদি পুলিশ ভেরিফিকেশন বাদে করেন তাহলে খরচ আরও কম দিলেও হবে। নড়িয়া উপজেলায় পুলিশ ভেরিফিকশন করাতে খরচ বেশি হয়, আমার নিজের এলাকায় হলে পুলিশকে ম্যানেজ করা যায়।’

আরও পড়ুন: ই-পাসপোর্ট কীভাবে করবেন?

পরে সাংবাদিক পরিচয়ে তার সঙ্গে কথা বলা হলে তিনি নিউজ না করতে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি খুব একটা পাসপোর্ট করি না। মাঝেমধ্যে দুই-একটা করি। আমি এই ছেলেটির (কাউসার আহমেদ) সব টাকা ফেরত দিয়ে দেবো।’

তবে পাসপোর্ট অফিসের যে কর্মকর্তার মাধ্যমে পাসপোর্ট করিয়ে নেন তার নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানান রাজন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক দালাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মাধ্যম ছাড়া পাসপোর্ট অফিসে গেলে সামান্য ভুলের কারণে পাসপোর্টের আবেদন ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যেসব ভুলের জন্য ফাইলগুলো ফেরত পাঠানো হয় সেগুলো আসলে তেমন কোনো ভুলই না। আমরা ওইসব পাসপোর্টের আবেদনপত্র নতুন করে জমা দেওয়ার জন্য আবেদনকারীর থেকে ১৫০০-২০০০ টাকা নিই। সেখান থেকে পাসপোর্ট অফিসের লোকেরা এক হাজার টাকা করে পান। তবে এ টাকা লেনদেনের বিষয়ে এডি (সহকারী পরিচালক) কিছু জানেন না। অফিসের অন্যসব লোকেরা এ টাকা ভাগযোগ করে নেন।’

আরও পড়ুন: ই-পাসপোর্টের ফি কত?

সবুজ নামের এক দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করাতে দড়ি হাওলা থেকে আসেন ইলিয়াছ শিকদার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমার মায়ের আরেকটি বিয়ে হয়েছে। সেখানে মায়ের বর্তমান স্বামীর নাম দেওয়া আছে। সেই ভোটার আইডি কার্ডে আমার বাবার নাম পরিবর্তন ও পাসপোর্ট করাতে সবুজ ভাইকে ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। শুনেছি পাসপোর্ট করাতে অনেক ঝামেলা হয়। ঝামেলা থেকে রক্ষা পেতে টাকাগুলো দিতে হয়েছে।’

তবে শরীয়তপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে দালালদের সিন্ডিকেট নেই বলে দাবি করেন সহকারী পরিচালক নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, বর্তমানে ই-পাসপোর্ট চালু হয়েছে। সেক্ষেত্রে আবেদনকারীকে নিজে এসে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে পাসপোর্ট গ্রহণ করতে হয়। তাই তৃতীয় পক্ষের কোনো ব্যক্তির অফিসে ঢোকার সুযোগ নেই। আমরা সবাইকে জানাতে চাই, অসাধু লোকেদের শরণাপন্ন না হয়ে সরাসরি সঠিক কাগজপত্র নিয়ে আমাদের কাছে চলে এলেই খুব দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব। আমরা এ বিষয়ে আন্তরিক রয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের অফিসের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর দালাল চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার সুযোগ নেই। তবে কেউ যদি জড়িত থাকেন বা এমন কোনো কিছুর সত্যতা পাই প্রয়োজনে আমি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।