তিন পার্বত্য জেলায় ২৫ লাখ চারা লাগিয়েছে সরকার
গাছগুলো থেকে ৪০-৫০ বছর ফলন পাওয়া যাবে
বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও রপ্তানি আয় বাড়াতে চায় সরকার
কফি ও কাজুবাদাম ঘিরে নতুন পরিকল্পনা সাজাচ্ছে সরকার। দেশের পার্বত্য অঞ্চলের মাটি কফি ও কাজুবাদাম চাষের উপযোগী। এই মাটি ও আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে প্রকল্পের আওতায় সরকারিভাবে লাগানো হয়েছে ফল দুটির ২৫ লাখ চারা। কিছু গাছে এরই মধ্যে ফলনও এসেছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, রপ্তানি থেকে আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য।
‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় তিন পাহাড়ি জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে লাগানো চারার প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এসব চারা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্পের সামগ্রিক উদ্দেশ্য বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলার ২৫টি উপজেলাসহ অন্য উপযোগী এলাকায় কফি ও কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণের মাধ্যমে কৃষকের আয়, কর্মসংস্থান এবং আর্থসামাজিক অবস্থার টেকসই উন্নয়ন।
পাহাড়ের ভাঁজে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে কফি-কাজুবাদাম
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) জানায়, কাজুবাদাম ও কফির জাত, ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদন ৫০ শতাংশ বাড়ানো, বিদ্যমান উৎপাদন এলাকা দুই হাজার হেক্টর থেকে ছয় হাজার হেক্টর করা, উৎপাদিত কাজুবাদাম ও কফির মাধ্যমে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক আয় বাড়ানো, প্রকল্প এলাকায় ৪৯ হাজার ৫শ জন কৃষকের দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ দারিদ্র্য বিমোচন ও পুষ্টি উন্নয়নে সহায়তা করা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ কার্যক্রমে নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড’। আইএমইডিতে দাখিল করা প্রতিষ্ঠানের প্রথম খসড়া প্রতিবেদনের ওপর সমীক্ষায় দেখা যায়, পাহাড়ে রোপণ করা চারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এই চারা প্রতিস্থাপনসহ প্রকল্পটি নিয়ে আরও কিছু নির্দেশনা দিয়েছে আইএমইডি। এর মধ্যে অন্যতম, যে সব চারা নষ্ট হয়েছে সে সব চারা প্রতিস্থাপন হচ্ছে কি না তা প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা। নিবিড় পরিবীক্ষণের জন্য নির্বাচিত সব এলাকায় প্রকল্পের বিভিন্ন খাতের বাস্তবায়ন অবস্থা প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে হবে।
পাহাড়ের ভাঁজে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে কফি-কাজুবাদাম
এছাড়া আইএমইডি নির্দেশিত নির্ধারিত ফরম্যাটে অডিট সংক্রান্ত তথ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করা, প্রকল্পের দুটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বের করা, প্রতিবেদনের বিভিন্ন স্থানে প্রকল্পের বরাদ্দ, ব্যয় ও অগ্রগতির তারতম্য সংশোধন করা।
আইএমইডি প্রতিবেদন প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে ২৫ লাখ কফি-কাজুবাদামের চারা রোপণ করেছি। তবে নানা কারণে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চারা নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতেও বিভিন্ন গাছের চারা লাগালে সব কিন্তু বেঁচে থাকে না। কিছু চারা নষ্ট হয়। সেই ধারাবাহিকতায় পাহাড়েও কফি-কাজুবাদামের কিছু চারা নষ্ট হয়েছে। তবে আমরা এসব চারা প্রতিস্থাপন করছি।’
কী কী কারণে কফি-কাজুবাদামের চারা নষ্ট হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কফি-কাজুবাদামের চারা এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে হাতে নিয়ে যেতে হয়, এটাও একটা কারণ। চারাগুলো সাধারণত বর্ষা মৌসুমে রোপণ করা হয়। বর্ষায় অনেক সময় নানা কারণে চারা নষ্ট হয়। তবে এসব চারা প্রতিস্থাপন একটা চলমান প্রক্রিয়া।’
আমরা এরই মধ্যে ২৫ লাখ কফি-কাজুবাদামের চারা রোপণ করেছি। তবে নানা কারণে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চারা নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতেও বিভিন্ন গাছের চারা লাগালে সব কিন্তু বেঁচে থাকে না। কিছু চারা নষ্ট হয়। সেই ধারাবাহিকতায় পাহাড়েও কফি-কাজুবাদামের কিছু চারা নষ্ট হয়েছে। তবে আমরা এসব চারা প্রতিস্থাপন করছি।- প্রকল্প পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম
কফি-কাজুবাদাম ফলন প্রসঙ্গে কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক বলেন, ‘এখন স্বল্প পরিসরে ফলন হচ্ছে। দেখুন আমরা যখন আমের চারা লাগাই সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ফলন আসে না, সময় লাগে। তবে আশা করছি আগামী দুই বছরে পূর্ণ ফলন পাবো। গাছগুলো থেকে ৪০-৫০ বছর কফি-কাজুবাদাম পাবো।’
পাহাড়ের ভাঁজে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে কফি-কাজুবাদাম
প্রকল্পের কার্যক্রম ২০২১-এর জুন মাসে শুরু হয়। প্রকল্পের শুরুতে দেশে কাজুবাদাম চাষ হতো ১৮শ হেক্টর জমিতে। কার্যক্রম বাস্তবায়নে বর্তমানে প্রায় ৪২শ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম চাষ হচ্ছে। একই সঙ্গে কফি চাষ ৬৫ হেক্টর থেকে বেড়ে ১৮শ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। এ সম্প্রসারণ অধিকাংশই দেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে কাজুবাদাম ও কফি চাষ সম্প্রসারণের ফলে আগে যেখানে জুম চাষ হতো সেখানে এখন কাজুবাদাম ও কফি চাষ হচ্ছে। উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ায় পার্বত্য এলাকার মানুষ কাজুবাদাম ও কফি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন
বাড়ছে কফি-কাজুবাদামের চাহিদা, পাহাড়ে ব্যাপক সম্ভাবনা
কফি চাষে বদলে যাবে পাহাড়ি জীবন
বেশি লাভের আশায় বাড়ছে কাজু বাদামের চাষ
অপ্রচলিত ফসল পাল্টাবে পাহাড়ের অর্থনীতি
ডিএই জানায়, যেখানে চারা নষ্ট হচ্ছে তা প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। এক থেকে দুই বছর বয়সী কফি-কাজুবাদামে স্বল্প পরিসরে ফল মিলছে। আগামী দুই বছরে কাজুবাদাম ও কফির পূর্ণ ফলন মিলবে। গাছগুলো ৪০ থেকে ৫০ বছর বাঁচবে এবং ফল দেবে। একটা গাছ থেকে বছরে ১০ থেকে ১৫ কেজি কাজুবাদাম ও তিন থেকে চার কেজি কফি পাওয়া যায়।
পাহাড়ের ভাঁজে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে কফি-কাজুবাদাম
দেশে কাজুবাদামের ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে কাজুবাদামের বাজার প্রায় ৭শ কোটি টাকার। প্রতি বছর গড়ে ২৫শ থেকে তিন হাজার টন প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানি হয়। দেশে কফির চাহিদা প্রায় দুই হাজার টন। গত এক দশকে গড়ে কফির চাহিদার প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫৬ শতাংশ। বছরে প্রায় ৬শ কোটি টাকার কফি দেশের অভ্যন্তরে বিক্রি হয়। ভোক্তা পর্যায়ে গত পাঁচ বছরে এ দুটি পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশে কফি প্রয়োজন দুই হাজার টন। কফি গাছগুলো পূর্ণ ফলনে গেলে চাহিদা মিটে যাবে, তখন আর রপ্তানি করা লাগবে না।
কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি
কাজুবাদাম এবং কফি চাষ সম্প্রসারণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনের ফলে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করছে। বিএসআরএম ও কাজী গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান রপ্তানির উদ্দেশ্যে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করছে। এ কারখানায় প্রায় ১২শ জনের মতো লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এছাড়া বিদ্যমান প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোতে প্রায় দুই হাজার জন শ্রমিক কাজ করছে। এসব শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী।
পাহাড়ের ভাঁজে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে কফি-কাজুবাদাম
রপ্তানি আয় বৃদ্ধি
এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশে উৎপাদিত কাজুবাদাম ও কফির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। দেশের পার্বত্য অঞ্চলের দুই লাখ হেক্টর অনাবাদি জমিকে কাজুবাদাম ও কফি চাষের আওতায় আনার কাজ চলমান। এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারলে উৎপাদিত কাজুবাদাম ও কফির মাধ্যমে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এক বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করা সম্ভব।
নতুন উদ্যোক্তা তৈরি
কাজুবাদাম ও কফির আবাদ সম্প্রসারণের ফলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশে বর্তমানে গড়ে উঠেছে কাজুবাদামের ২২টি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে এসব কারখানা স্থাপিত হয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনের ফলে সহজ হচ্ছে দেশে উৎপাদিত কাজুবাদামের বাজারজাতকরণ। দেশে উৎপাদিত কফিও দেশের বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে। প্রকল্পের প্রভাবে নতুন নতুন চাষি ও উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে।
পাহাড়ের ভাঁজে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে কফি-কাজুবাদাম
বর্তমানে সারা বিশ্বে মোট ৩৫ লাখ মেট্রিক টন কাজুবাদাম উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ১২ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরিকোস্ট, নাইজেরিয়া, ঘানা ও বেনিনে। তবে এসব দেশ কাজুবাদাম প্রসেসিং করতে পারে না। আফ্রিকার দেশগুলো মাত্র ১০ শতাংশ প্রসেসিং করে। এদের কাজুবাদাম ভিয়েতনাম প্রসেসিং করে বছরে চার বিলিয়ন ডলার আয় করছে।
সারা বিশ্বে কাজুবাদামের বাজার ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ভিয়েতনাম একাই চার বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। বাকিগুলো ভারত ও পশ্চিম আফ্রিকার কিছু দেশ থেকে রপ্তানি হয়। কাজুবাদামের বড় মার্কেট যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশও কফি-কাজুবাদাম থেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়-সাশ্রয় করতে পারে।