মে মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা।
জীবন-যাপনের ব্যয় বেড়েছে অনেক গুণ। কিন্তু আয় বাড়েনি সেভাবে। অনেকের আয় আরও কমেছে। মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত লোকজন। অনেকে আপস করেছেন খাদ্য তালিকার সঙ্গে। কেউ ভাঙছেন সঞ্চয়, কেউ আবার ডুবছেন দেনায়।
ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং অপর্যাপ্ত সরবরাহ একজন আমদানিকারকের মাথাব্যথার বড় কারণ। প্রয়োজনের তুলনায় কম সরবরাহ থাকায় কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না প্রস্তুতকারকরা। প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে। সংকট সৃষ্টি হয়েছে দেশীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে, যা মূল্যকে প্রতিনিয়ত উসকে দিচ্ছে। বাড়ছে সাধারণ মানুষের কষ্ট। অনেক ক্ষেত্রে রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। এপ্রিল মাসে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ নেমেছে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
বেসরকারি বিনিয়োগের শ্লথগতির কারণে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। বেকারত্বের হার বাড়ছে। বড় হচ্ছে শিক্ষিত বেকারদের চাকরির সাক্ষাৎকারের সারি। কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পেয়ে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে অনেকে যোগ দিচ্ছেন যোগ্যতার চেয়ে নিম্ন পদে।
রপ্তানি আয়ে নেই সুখবর। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মে মাসের রপ্তানি কমেছে ১৬ শতাংশ। পণ্য রপ্তানি থেকে মে মাসে আয় হয়েছে ৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ১৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কম। গত বছরের মে মাসে আয় হয়েছিল ৪ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার।
বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় চাপের মুখে। পাশাপাশি দেশীয় সমস্যা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পারে।
প্রবাসী আয় যদিও কিছুটা ইতিবাচক ধারায় রয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো কিংবা শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে। সদ্য সমাপ্ত মে মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে মোট ২২৫ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, যা প্রায় চার বছরের (৪৬ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ, আর এযাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালের জুলাই মাসে।
নানাবিধ বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিকূল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আজ বৃহস্পতিবার (৬ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন।
যদিও অর্থমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করার। কিন্তু সম্ভাব্য কর হারে জীবনযাপনের ব্যয় আরো বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
এখন প্রশ্ন হলো সরকার যে আজ সংসদে বাজেট পেশ করবে তা কি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার এবং বাবসায়ীদের চলমান চাপ কমাবে না বাড়াবে?
সাড়ে তিন লাখ টাকার করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত থাকবে। একদিকে জীবনযাত্রার ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, অন্যদিকে অপরিবর্তিত আয়। ফলে সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির যে প্রভাব তা কমবে না।
আরও পড়ুন
দাম কমতে পারে যেসব পণ্যের
দাম বাড়তে পারে যেসব পণ্যের
করজালে ধনী থেকে নিম্নবিত্ত, বিনাপ্রশ্নে কালো টাকা সাদা
আমদানিনির্ভর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের শুল্ক অপরিবর্তিত থাকা কিংবা বাড়ালে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সহজ নয় বরং আরও কঠিন করবে।
নতুন কিছু পণ্য মূল্য সংযোজন করের আওতায় আসার কথা বলা হয়েছে, যা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হতে পারে, যদি তা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য হয়।
হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের এবং বয়স্ক লোকদের একটু স্বস্তি দিতে ও তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের চাপ কমাতে সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনীতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি আওতা বাড়াতে হবে। কিন্তু আগামী বাজেটে আওতা বাড়ানোর ইঙ্গিত থাকলে বরাদ্দ বৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ।
করোনাভাইরাস মহামারি পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশ গড়ে ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছিল কয়েক বছর ধরে। কিন্তু চলমান অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৫.৮২ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে।
আগের ধারায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে।
বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় কর কাঠামো, ব্যবসায়িক অবকাঠামো, প্রচলিত আইনের জটিলতা এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ। এক্ষেত্রে হয়রানি এবং সেবা পেতে ঘুস- এ সমস্যা আরও গভীরতর করে। ব্যাংকখাতের বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং লাগামহীন খেলাপি ঋণ বেসরকারি ঋণ প্রবাহকে সংকুচিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এরই মধ্যে সরকার আগামী বাজেটে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ব্যাংক থেকে সরকারের বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করবে এবং বিনিয়োগ কমে যাবে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলমান অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদনের ৩০ দশমিক ৯৮ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩২ দশমিক ০৫ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ২৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।
সুতরাং, বিনিয়োগ চাঙা করতে আইনের সংস্কার, ব্যাংকখাতে শৃঙ্খলা আনা এবং সরকারের বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংকখাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।
সংস্কার না করলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে না। আর্থিক ও রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কারের বিষয়টি বাজেটের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাসহ তুলে ধরতে হবে। বাজেটের আকার বাড়ানোর চেয়ে বাস্তবায়নের প্রতি নজর দিতে হবে। তা না হলে শুধু বাজেটের আকার বড়ই হবে, মানুষ ও ব্যবসায়ীরা এর উপকার পাবে না।
বর্তমানে ব্যাংকখাতে যে নড়বড়ে অবস্থা বিরাজ করছে তা থেকে বের হতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। আর্থিক খাতের চলমান দুর্বল অবস্থা চলতে থাকলে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ কমে যাবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য এই মুহূর্তে কাম্য নয়।
রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ার ফলে সরকারের ঋণ বাড়ছে। ফলে এই বাজেটেও সরকার বর্ধিত আকারে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত কর ধরা হচ্ছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর করবহির্ভূত খাত থেকে প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
এবার বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা
বিদ্যুতে বড় লোকসান, পানি বেচে আসবে লাভ
বাজেটে কী চান খেটে খাওয়া মানুষ?
বাস্তবসম্মত নয় এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করলে ব্যবসায়ীদের প্রতি এবং যারা কর দিচ্ছেন এমন ব্যক্তিদের ওপর চাপ বাড়বে। কিন্তু রাজস্ব আহরণ বাড়বে না। অর্থনীতি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং সরকারের আয় বাড়ানো প্রয়োজন। তার অর্থ এই নয় যে বাজেট হবে রাজস্ব বাড়ানোমুখী। এতে শিল্পায়ন হবে না। বাজেটে এমন নির্দেশনা থাকা দরকার যাতে শিল্পায়ন বাড়বে। আর শিল্পায়ন বাড়লে রাজস্ব আহরণ বাড়বে।
শুধু কর হার বাড়ালে রাজস্ব আহরণ বাড়বে না, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হলে কর ফাঁকি বন্ধ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সরকারকে যেমন রাজস্ব নিয়ে ভাবতে হবে, তেমনি শিল্পের বিকাশ নিয়েও। রপ্তানিমুখী শিল্প বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা।
উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার পর, বাংলাদেশের রফতানিকারকরা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার হারাবে অনেক দেশে। অন্যদিকে, আগামী বাজেটে কর বাড়ানো এবং নগদ সহায়তা কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
বর্তমানে ১ শতাংশ প্রদান করতে হয় তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের। ব্যবসায়ীদের দাবি থাকলেও অপরিবর্তিত থাকছে উৎসে কর। এতে শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে।
তাই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে যে ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তা সমাধানের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ থাকতে হবে আগামী বাজেটে। একই সঙ্গে চলমান আর্থিক ও নীতিগত সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যবসায়ীদের সমস্যার দিক-নির্দেশনা এবং চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার যথাযথ পদক্ষেপ অর্থনীতির চাপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।