৩০ আগষ্ট ২০২৩
আবার কখনও ঝুম বৃষ্টি, আবার ফকফকা রোদ। ঋতুর প্রবাহে এখন শরৎ কাল হলেও প্রকৃতিতে এখনও বর্ষার প্রভাব বিরাজ করছে।
বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের গাছপালাও সজীব হয়ে ওঠেছে অন্যান্য সময়ের চেয়ে। সুনসান নীরবতায় সুন্দরবন যেন প্রকৃতির নিজস্ব অপরূপ সাজে সেজে ওঠেছে। দীর্ঘ ৩ মাস ধরে বনে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ থাকায় বনের ওপর চাপ কমেছে। তাই এখন ভিন্ন রূপ সুন্দরবন ও বনের বন্যপ্রাণীর মাঝে।
সুন্দরবনের ঘন সবুজ গাছের মাঝেই হঠাৎ দেখা যায় হরিণের পাল, নীরবতা ভেঙে হঠাৎ শোনা যায় পাখির ডাক। ঝাঁকে ঝাঁকে কাঁকড়া, ডলফিন ও কুমিরের দেখা মিলছে। মানুষের কোলাহল ও নৌযানের শব্দ না থাকায় বনের বিভিন্ন ধরণের বন্যপ্রাণীর ঝাঁকের দেখা মিলছে বনের নদ-নদী ও খালের পাড়গুলোতে। আর ভাগ্যে থাকলে দেখা মিলবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। সুন্দরবনের এই অপার্থিব সৌন্দর্য সব সময় দেখা মেলে না।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মাছ ও বন্যপ্রাণীর বংশবৃদ্ধি, বিচরণ এবং প্রজনন কার্যক্রমের সুরক্ষায় জুন-জুলাই-আগস্ট এই তিন মাস বনের নদী-খালে মাছ শিকার আহরণে বনবিভাগের নিষেধাজ্ঞা ছিল। শুধু মাছ শিকারই বন্ধ নয়, নির্দিষ্ট এসময় জুড়ে বনের অভ্যন্তরে ও অভয়ারণ্যে পর্যটকদের প্রবেশও ছিল বন্ধ।
স্থানীয় জেলে-বাওয়ালী মৌয়ালরা বলছেন, সুন্দরবনে আগের তুলনায় বনে পশুপাখি অনেক বেশি চোখে পড়ছে। এমনকি নদী-খালে মিলছে নানা প্রজাতির মাছ।
সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বর্ষায় সুন্দরবন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেছে। বইছে নির্মল বাতাস। চারপাশে রয়েছে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা। জোয়ারের উচ্চতাও একটু বেশি এ সময়। এ সময়ে তাই বনের বেশিরভাগই পানিতে ডুবে যায়। সন্ধ্যা নামলেই পাখির কলতানে মুখর হয়ে উঠে চারপাশ। দীর্ঘ বিশ্রামে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা। হরিণ শাবকগুলো ছোটাছুটি করছে যত্রতত্র। সুন্দরী, বাইন, গড়ান, বনফল কেওড়ার ডালে ডালে পাখির আনাগোনা বেড়েছে। সুন্দরবনের নদী ও খালে যত্রতত্র কুমিরের দেখা মিলছে।
পাইকগাছা উপজেলার গড়ইখালী এলাকার বনজীবী শাফায়াত হোসেন বলেন, তিন মাস সুন্দরবনের পর্যটক আসা বন্ধ থাকায় বন্যপ্রাণীগুলো অবাধে চলাচল করছে। জেলে প্রবেশ নিষেধ থাকায় বনের নদী ও খালে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার লাভ করেছে।
সুন্দরবন লাগোয়া দাকোপের পশ্চিম খেজুরিয়ার বাসিন্দা দেবাশীষ মণ্ডল বলেন, ৩ মাস পর্যটক আসা বন্ধ থাকায় বনের বনজ সম্পদ ও বন্যপ্রাণীকূলের অনেক উপকার হয়েছে। যত্রতত্র বন্যপ্রাণীর দেখা মিলছে। নদী ও খালে প্রতিদিনই কুমিরের দেখা মিলছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জে কাশিয়াবাদ স্টেশন কর্মকর্তা শ্যাম প্রসাদ বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনেরও কিছুটা বিশ্রাম দরকার। সারা বছর পর্যটক, জেলে ও বনজীবীদের পদচারণায় কিছুটা হলেও বিরক্ত থাকে বন্যপ্রাণীরা। তিন মাস বন্ধ থাকায় বন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। পর্যটকবিহীন থাকায় সুন্দরবন যেন হারানো সবুজ সতেজ যৌবন ফিরে পেয়েছে। এ সময়ে বনের মধ্যে কোন পরিবেশ দূষণ হয়নি। নিরাপদ শব্দহীন নিশ্চিন্ত পরিবেশ পেয়ে বন্যপ্রাণীরা অবাধে সারা বন ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছে হলেই পানি খেতে নামছে নদী-খালে। স্বাভাবিক সময়ে পর্যটন স্পটগুলোর কাছে আসতে ভয় পেলেও এখন তারা আগের মত আর ভয় পাচ্ছে না।
পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. মো. আবু নাসের মোহসিন হেসেন বাংলানিউজকে বলেন, জেলেরা সুন্দরবনের নদী বা খালের পাড়ে যখন নামে তখন তারা পাড়ে হাঁটতো। এতে নদী বা খালের পাড়ের জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে নষ্ট হতো। বিশেষ করে এক ধরণের পাখি, কচ্ছপ, শামুক, ঝিনুক এই ধরণের কিছু ইকো সিস্টেম বিঘ্ন ঘটতো জেলে বাওয়ালিরা হাঁটা হাঁটি করলে। গত ৯০ দিনে স্মার্ট প্যাট্রল টিমের কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছি খাল বা নদীর পাড়ের প্রতিবেশ সংরক্ষিত হচ্ছে। শামুক, ঝিনুক, পাখির উপস্থিতি বেশ লক্ষ্য করা গেছে। এটা আমাদের জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের জন্য। এ সময় কাঁকড়া এবং সুন্দরী ফল পেকে ঝরে পরেছে। বর্ষার এসব ফল জোয়ারের পানিতে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ভেসে গিয়ে নদীর পাড়গুলোতে ঠিকমতো বসছে এবং অঙ্কুরোদগম হচ্ছে। সুন্দরবনের উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগমের হার বেড়েছে এই ৯০ দিনে। এই দুইটা চোখে পড়ার মতো। এছাড়া আর একটা লক্ষণীয় তা হলো সুন্দরবনে পোনা ও মাছ ধরা নিষেধ থাকার কারণে পাইকগাছা ও কয়রার উপরের অংশে যেখানে নদী ও খাল প্রবেশ করেছে সেখান থেকে মানুষ মাছ ধরছে। গ্রামের মধ্যে যেখানে আগে কখনো পোনা পাওয়া যায়নি। ৯০ দিনে মানুষের আনা গোনা বা জাল ফেলার পায়ের কোন ছাপ দেখা যাচ্ছে না। যার কারণে জীব বৈচিত্র্য বাড়ছে।