সবুজ মাঠ এখন পাকা ধানে ভরপুর। আমন ধানের সোঁদা গন্ধে ভরে উঠেছে আবহমান বাংলা। পাকা ধানের ম-ম ঘ্রাণে মাতোয়ারা কৃষক। মাঠে মাঠে সোনা রঙা ধানের ছড়াছড়ি। দিগন্তজোড়া প্রকৃতি ছেয়ে গেছে হলুদ রঙে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমন ধান কাটা শুরু হলেও চালের বাজারে প্রভাব পড়েনি। ধানের হাটেও কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। হিসাব কষে এবার লোকসানের কথাই বলছেন কৃষকরা। মহাজনের ঋণ পরিশোধ নিয়ে কৃষকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এর মধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে এসেছে হরতাল-অবরোধ।
সূর্য ওঠার আগেই কাস্তে হাতে মাঠে ছুটছেন কৃষক। সারা দেশে শুরু হয়েছে ধান কাটার উৎসব। ধান মাড়াই, বাছাই আর বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত কৃষক-কৃষাণী। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, বগুড়া, বরেন্দ্র অঞ্চল, মাগুড়া, দিনাজপুর ও নওগাঁ এলাকায় আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। বরেন্দ্র অঞ্চল ও ময়মনসিংহের পাহাড়ি এলাকায় ধান কাটা ও মাড়ানোর মিছিলে যোগ দিয়েছেন নারী কৃষি শ্রমিকরাও। একদিকে ধান কাটা হচ্ছে অপরদিকে সেই ধান মাড়াই করা হচ্ছে। রাস্তায় ধান মাড়াই ও শুকানো হচ্ছে। বাজারভেদে মোটা আমন ধান ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি মানের ধানি গোল্ড ধান এক হাজার ৫০ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। আর চিকন জাতের ধান পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ১২২০ টাকা মণ। মোটা স্বর্ণা ধান ১১শ’ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, এবার বৃষ্টির অভাবে সেচ দিয়ে আমন উৎপাদন করা হয়েছে, বাড়তি দামে সার ও ডিজেল কিনতে হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে ধানের দামে হতাশ কৃষক। এ বছর আমনের আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে ৩৩ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। দেশের ৪ লাখ ৯০ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এ প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার পেয়েছেন। তারপরও অনেক কৃষকের উৎপাদন খরচই উঠছে না আমন ধান বিক্রি করে।
দিনাজপুরে আগাম জাতের ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। গত মৌসুমে আগাম জাতের বিনা ৯০ ধানের ৭৫ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছিল চার হাজার ২০০ থেকে চার হাজার ৩০০ টাকা। এবার সে ধান বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ২৮০০ টাকা। অপরদিকে বিনা ১৭, বিনা ৭৫, বিআর ৫১ ধান ৭৫ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২১৫০ টাকা থেকে ২২৫০ টাকা। যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৩০০ থেকে ৩১০০ টাকা। কাহারোল উপজেলার কৃষক আতাহার আলী জানান, ধানের দাম নেই। বাজারে ক্রেতাও নেই। এবার ধানে লোকসান না হলেও লাভের মুখ দেখা হবে না। সদর উপজেলার মিস্ত্রিপাড়া গ্রামের কৃষক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মৌসুমে আগাম জাতের বিনা ৯০ দানের দাম বেশি হওয়া এবারও সেই ধান চাষ করেছি। কিন্তু পাইকার বা মিল মালিকরা ধানের দাম বলছেন না।’
এ বিষয়ে কৃষিবিদ আব্দুর রহমান ফজলু বলেন, সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ৩০ টাকা কেজি ধরে ২ লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই হিসেবে প্রতি মণ ধানের দাম দাঁড়ায় ১২শ’ টাকা মণ। নভেম্বরের মধ্য সপ্তাহ থেকে এই সংগ্রহ শুরু হবে। সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু না হওয়ায় ধানের দাম তলানিতে নেমেছে। ফড়িয়া ও পাইকাররা কম দামে ধান কিনে মজুত করছেন। যখন কৃষকরা তাদের ধান বিক্রি শেষ করবেন। তখন সরকারি খাদ্যগুদামের কর্মকর্তারা ফঁড়িয়াদের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনে থাকেন।
নেত্রকোনার দুর্গাপুরের শ্রীপুর গ্রামের কৃষক আবু সামা জানান, ‘আমন ধান চাষ হচ্ছে সম্পূর্ণ বৃষ্টিনির্ভর। কিন্তু এবার মৌসুমে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। ডিজেলচালিত সেচ পাম্প দিয়ে আমন ধান আবাদ করা হয়েছে। এ ছাড়া সার ও ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি করার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর মধ্যে বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। চাল কিনলে তো মাছ কেনা যায় না। এবারও ধানের দাম কম। সাধারণত ধান বেচে কৃষাণীর জন্য নতুন শাড়ি, শীতের কাপড়, ইলিশ মাছ কেনা, বাচ্চাদের খেলনা আর রঙিন জামা কেনা হয়। কিন্তু লোকসানে ধান বেচে ঋণ পরিশোধ করা নিয়েই চিন্তায় আছি।’
শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকার কৃষক রফিক মিয়া বলেন, ‘সেচ দিয়ে ধান চাষ করে, এখন লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য। ধান বেচে ছেলের স্কুলের বেতন দিতে হবে। বাজারে সব কিছুর দাম বেশি। অবরোধের কারণে হাটবার ছাড়াও ধানের ক্রেতা পাওয়া যায় না। ট্রলি দিয়ে ধান বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে আগের চেয়ে ট্রলি ভাড়া বেড়েছে। সব দিক দিয়ে আমরা লোকসানে পড়েছি।’
গ্রামের পাকা রাস্তাগুলো হয়ে উঠেছে কৃষকের ধান শুকানো ও মাড়ানোর উঠান। রাস্তায় ধান মাড়াই ও শুকানো হচ্ছে। সারা দেশেই চলছে আগাম জাতের আমন ধান কাটা। উৎসাহ আর উদ্দীপনায় চলছে কৃষকের কাস্তে। এবার হাটে আগাম ধানের ন্যায্য দাম মিলছে না। গত বছর যে ধান ১৩শ’ টাকা মণে বিক্রি হয়েছে। এবার তা ১২শ’ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, সাধারণত মধ্য নভেম্বর থেকে সারা দেশে শুরু হবে পুরোদমে ধান কাটা। পুরোদমে ধান কাটা শুরু হলে ধানের দাম আরও কমে যাবে, আশঙ্কা কৃষকের। তাই অনেকে আধা-পাকা ধানই দ্রুত বিক্রি করে দিচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, এ বছর আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫৯ লাখ হেক্টর। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ টন চাল। ২০২১-২২ সালে উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৫০ লাখ টন চাল আর ২০২০-২১ উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৪৫ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত ধানের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে আমন থেকে। বাকি ৬০ শতাংশ মেঠায় আউশ ও বোরো।