এই তো কিছুদিন আগেও সোনালু রোদমাখা সকালে আলো ঝলমলে সূর্যের মিষ্টি তাপ চোখে পড়তেই ভেঙে যেত প্রশান্তির ঘুম। চরম বিরক্তিতে মন না চাইলেও উপায় ছিল না আর ঘুমিয়ে থাকার। প্রকৃতির এমন অসহ্য রসিকতায় আজ বাধসেধেছে বেরসিক বৃষ্টি। পাংশুটে আকাশ সাদা-কালো মেঘে ছেয়ে আড়াল করছে রক্তিম সূর্যকে। এই বুঝি অঝোর ধারায় ঝরবে বারিধারা। ঝুমঝুম নূপুরের শব্দে এখন যেন আর ঘুম ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। এই তো, এসে গেছে অনির্দেশ্য বর্ষাকাল। দূর আসমানের পুরোটাজুড়ে কখনো কালো মেঘের ঘনঘটা, কখনো এক চিলতে রোদের ফাঁকে মুখ কালো করা মেঘের ভিড় অথবা হঠাৎ করেই মুষলধারায় বৃষ্টি- অযাচিত এই ঋতু যেন শোনে না কারও কথা।

বিরহ- আলস্যের বর্ষা বছর ঘুরে আবার এসেছে তার নিজস্ব ভঙ্গিতেই, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তার প্রিয় সৌন্দর্য কদমফুলকে। গ্রীষ্মের প্রখরতা কমাতে যখন আম, কাঁঠালের ঘ্রাণে মুখর চারপাশ, ঠিক সে সময় আষাঢ়ে বাদলের দিনে আগমন ঘটেছে হৃদমোহিনী কদমফুলের। তাই তো বৃষ্টির অবিরাম বর্ষণের সঙ্গে সহসাই ভেসে আসে কদমফুলের রেণুর মিষ্টি সুবাস। বৃষ্ট স্না?নে কদম ফিরে পায় তার রূপ। কদম আর বর্ষা একে অন্যকে আলিঙ্গন করে রয়েছে বহুকাল ধরে। এ জন্য কদমফুলকে বলা হয় বর্ষার দূত।

রূপসী তরুর অন্যতম রূপবতী হলো কদমফুল। গাছে গাছে সবুজ পাতার ডালে থোকায় থোকায় গোলাকার মাংসালো পুষ্পাধার আর তার থেকে বের হওয়া সরু হলুদ পাপড়ির মুখে সাদা অংশ কদমকে সাজিয়ে তুলেছে ভিন্নভাবে। গোলাকার হলদে-সাদা মিশ্রত ফুল দেখতে যেন ভোরের ঊষা। বর্ষার মেঘের সঙ্গে মিতালি বলেই কিনা এর আরেক নাম মেঘাগমপ্রিয়। আর নারীর সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করে অনেকেই বলে ললনাপ্রিয়। এছাড়া সুরভি, প্রাবৃষ্য, বৃত্তপুষ্প, সিন্ধুপুষ্প, কর্ণপূরক, ভৃঙ্গবলস্নভ, মঞ্জুকেশিনী প্রভৃতি নামেও কদমের পরিচিতি আছে। এত এত ভিন্নতার ছোঁয়ায় কদম হয়ে উঠেছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য।

একটি কদম্বগাছ হাজারো বলা, না বলা কথার সাক্ষী হয়ে আবহমান বাংলার মানুষের সঙ্গে গড়ে তুলেছে নিবিড় সখ্যতা। গোলাপ, জবা, বকুল, কৃষ্ণচূড়ার মতোই কদমফুল মিশে আছে বাঙালির মননে, ভাব ভাবনার অন্তরীক্ষে হয়ে উঠেছে সাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। কদমতলায় অচেনা পথিকের বাঁশির সুরে উতলা রমণীর আকুলতা নিয়ে লেখা পলস্নীকবি জসীমউদদীনের গান আজও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে সিক্ত কোনো বিকেলে তিনটে কদমফুল হাতে প্রেমিকের অপেক্ষার গল্পগুলো তো চিরায়ত। সেই গল্পে গোধূলিরাঙা আলোয় মন-মহুয়ায় আনন্দের সুর বাজায় অনুগামী কাদম্বিনী। আবার অপেক্ষার প্রহর শেষে প্রিয় মানুষটার হাত ধরতে না পারার আক্ষেপ আর চোখের ভাষা না বোঝার আফসোসে কখনো কখনো অভিমানী হয় ললনাপ্রিয় গাছটিও। ঝুম বৃষ্টির সুরে তখন বাতাসে দোল দিয়ে কদমফুলের সেই অভিমান ভাঙানো হৃদয়ের নয়ন-চিত্তকেই নাড়িয়ে দেয়। বাতাসে দোল খাওয়া স্নিগ্ধ সতেজ কদমফুলের তালে তালে পা নেচে হয় পাগলপারা।

কদম ছাড়া বর্ষা যেন একেবারেই বেমানান। প্রাচীরের ধারে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল কদম গাছগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় বর্ষা তার সবটুকু ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে মোটেই কার্পণ্য করে না। ফুলের পরাগ বেয়ে বৃষ্টির স্বচ্ছ জল চুঁইয়ে পড়ে আড়ষ্ট নেশার উদ্রেক তৈরি করে। ‘বাদল-দিনের প্রথম কদমফুল করেছ দান/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এই চরণ যেন দিন দিন আধুনিক জীবনে বর্ষা আবাহনের অনন্য ব্যঞ্জনায় পরিণত হয়েছে। হোক শহর কিংবা গ্রাম একগুচ্ছ কদমফুল ছাড়া বর্ষার বার্তা জানাতেও এখন দ্বিধা আর সংকোচ।