দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের পাশাপাশি দেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গণভবনের সবুজ লনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠান সংবাদ সম্মেলনে রূপ নেয়। এসময় বিদেশি সাংবাদিকদের নানান প্রশ্নের জবাব দেন শেখ হাসিনা।
সোমবার (৮ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে তিনটার পরে অনুষ্ঠানের শুরুতে শেখ হাসিনা ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। পরে সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশ ও তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের বাংলাদেশে আসার জন্য তিনি নিজের, পরিবার ও দেশের মানুষের পক্ষ থেকে সবার প্রতি ধন্যবাদ জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদের (বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক) আগমনের কারণে আমাদের দেশের গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার আরও সুরক্ষিত হয়েছে। আপনারা যার যার দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের কথা বলবেন। আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর। আবহাওয়াও অনেক ভালো। আপনাদের আগমন আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করবে, শক্তিশালী করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
পরে তিনি বেশ কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকের প্রশ্নের জবাব দেন।
সরকার গঠনের পর সরকারের অগ্রাধিকার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। ২০২৬ সালে যার যাত্রা শুরু হবে। এখানে যেমন অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, তেমনি বেশকিছু সুযোগ-সুবিধাও পাবো। এরই মধ্যে আমরা কীভাবে কাজ করবো সেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি, কয়েকটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এদেশে কোনো ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবে না, সবার জন্য ঠিকানা করে দেবো।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিদ্যুতের আলো প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছি, তা অব্যাহত রাখতে টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। এখন ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা। যেখানে সরকার, অর্থনীতি, সমাজ সবই হবে উন্নত স্মার্ট। দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে হবে। বাংলাদেশে একটি মানুষও হতদরিদ্র থাকবে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে বন্ধুপ্রতীম দেশ ও সহযোগী সংস্থাগুলো থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে এটাই চাই।’
বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না করায় গতিশীল গণতন্ত্র থাকবে কি না, বিবিসির এক সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। কোনো দল যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তার মানে এই নয় যে দেশে গণতন্ত্র নেই। আপনাকে বিবেচনা করতে হবে মানুষ অংশ নিয়েছে কি না। আপনি যে দলের (বিএনপি) কথা বলেছেন তারা আগুন দেয়, মানুষ হত্যা করে। কিছুদিন আগে ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ মেরেছে। এটা কি গণতন্ত্র? এটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। তারা রাজনৈতিক দল নয়, সন্ত্রাসী দল। দেশের মানুষ এটা গ্রহণ করে না। এ ধরনের ঘটনা এ দেশে একাধিকবার ঘটেছে। আমরা ধৈর্য দেখিয়েছি। মানুষের অধিকার রক্ষা করতে হবে।
ভোট কম পড়া নিয়ে অপর প্রশ্নের জবাবে সরকার প্রধান বলেন, ‘কে নির্বাচনে আসলো বা না আসলো, সেটি রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে, নির্বাচনে মানুষ অংশগ্রহণ করেছে কি না সেটাই বড় কথা। মানুষের অংশগ্রহণই বড় কথা।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি মানুষকে এ নির্বাচনে ভোট না দিতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মানুষ তাদের কথা শোনেনি।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘বিএনপি কত মানুষ মেরেছে সে প্রশ্ন তিনি (প্রশ্নকর্তা) করেননি। তারা ২০১৪-১৫ সালে প্রায় তিন হাজার মানুষকে পুড়িয়েছে, পাঁচশ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এতে কীভাবে তাদের (বিএনপি) গণতান্ত্রিক দল বলা যায়। তারা সন্ত্রাসী দল এবং মানুষ তাদের সমর্থন করে না।’
পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে অপর এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, `প্রতিটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। কারণ আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র হলো- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’
ভারতীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের অনেক বড় বন্ধু। ১৯৭১ সালে তারা আমাদের সমর্থন করেছে। পঁচাত্তরের পর তারা আমাকে ও আমার বোনকে আশ্রয় দিয়েছে। ঘরের পাশের প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে আমাদের অনেক সমস্যা থাকলেও আমরা তা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করেছি। প্রতিবেশী হিসেবে তাদের সঙ্গে আমাদের চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। অন্য দেশের সঙ্গেও আমার ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
আগামী পাঁচ বছর বহির্বিশ্বের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক প্রত্যাশা করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি অর্থনৈতিক উন্নতি, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন নিশ্চিত করাই আমার প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে আমরা সব ধরনের কাজও শুরু করেছি। এটা আমরা পূরণ করতে চাই।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে করণীয় নিয়ে মার্কিন এক পর্যবেক্ষকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এটা এখন আপনাদের সরকারের ওপর নির্ভর করছে।
অপর এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিহিংসাপরায়ণ নই। আমি কারও ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করিনি। আমি খোলা মনের ও খুব উদারপন্থি মানুষ। দেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলো স্বাধীনভাবে কথা বলতে ও লিখতে পারে। তারা তাদের কাজ করতে পারে, আমি কখনো হস্তক্ষেপ করি না। যখন কেউ সমালোচনা করে তখন তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে শোধরানো যায়, আমি এভাবেই দেখি।
আপনার এই বিজয় উদযাপনের অংশ হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমা করার কথা বিবেচনা করবেন কি না?- এমন প্রশ্নে জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘শ্রম আদালত তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। তিনি তার নিজের কোম্পানির যাদের বঞ্চিত করেছেন তারাই মামলা করেছেন। তিনি শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছেন। এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই। তাই তাকে ক্ষমা করার প্রশ্ন আমার কাছে আসা উচিত নয়। তার নিজের কোম্পানির কর্মচারীদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
আরেক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা জানান, তিনি মাতৃস্নেহের সঙ্গে দেশের জনগণকে দেখেন। লিঙ্গ পরিচয় তার কাজের ক্ষেত্রে কোনো বাধা বলে তিনি মনে করেন না।
দেশের নেতৃত্ব দানকারী একজন নারী হিসেবে কোনো বাধা অনুভব করেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি আমার জনগণের জন্য কাজ করার চেষ্টা করি এবং হ্যাঁ, আমি আপনাকে একটি জিনিস বলতে পারি। আপনি জানেন… একজন নারী হিসেবে একজন মা পরিবারের দেখাশোনা করেন, সন্তানদের দেখাশোনা করেন, (আমি) সন্তানদের লালন-পালন করেছি। সুতরাং, মাতৃস্নেহের সঙ্গে আমি আমার জনগণকে দেখি, আমি তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করি।
বাংলাদেশের শীর্ষ পদে একজন নারীর দায়িত্ব পালনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আসলে আপনি যখন দেশ চালাবেন, তখন আপনার চিন্তা করা উচিত নয় যে আপনি একজন পুরুষ নাকি নারী।’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, হ্যাঁ… আমি এ সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি। কিন্তু আমি যখন কাজ করি, যখন আমি কাজ শুরু করি, আমি কখনোই ভাবিনি যে আমি একজন নারী, আমার সীমাবদ্ধতা ছিল না।
একটা জিনিস, আমি সবসময় আমার জনগণের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা অনুভব করি যে আমাকে তাদের সেবা করতে হবে। সুতরাং আমি কখনোই মনে করিনি যে এটি এমন একটি দায়িত্ব যা আমাকে পালন করতে হবে। আমি মনে করি এটি আমার দেশ, আমার জনগণের সেবা করার এবং তারা যাতে উন্নত জীবন পায় তা নিশ্চিত করার একটি সুযোগ।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, বেনজির ভুট্টো, ইসরায়েলের গোল্ডামেয়ার এবং যুক্তরাজ্যের মার্গারেট থ্যাচারের মতো মহান নারীদের ছাড়িয়ে পঞ্চম মেয়াদে জয়ের বিষয়ে কেমন অনুভব করছেন- জানতে চাওয়া হলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনি যে নারী নেত্রীদের নাম নিয়েছেন তার মহান ছিলেন। আমি তাদের মতো নই। আমি একজন খুব সাধারণ মানুষ। মানুষের জন্য কাজ করতে পারছি, এটাই বড়।