লেখকঃ মোঃ হায়দার আলীঃ মহান ও নিবেদিত পেশা হিসেবে শিক্ষকতা সর্বজন স্বীকৃত। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই মনে করা হয় শিক্ষকদের। পাঠদানে আত্ম-নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিহিত থাকা সুপ্ত মেধা জাগ্রত করা, দুঃস্থ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজের অর্থ ব্যয়ে দেশ সেরা হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষকও দেশে বিরল নয়। বেসরকারী শিক্ষক সমাজ ৯৭ ভাগ শিক্ষাদান করেও আজ উচ্চতর স্কেল বঞ্চিত, বেতন বৈষম্যের স্বীকার, হয়রানীর স্বীকার, বাড়ীভাড়া,১০০০/ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০/ টাকা, সিঁকিভাগ ইদ বোনাস, বেতন কম হওয়ায় দ্রব্যমূল্যের গরম বাজারে তারা বেসামাল হয়ে পড়েছেন। সবার বেলায় শতভাগ আর বেসরকারী শিক্ষকদের বেলায় সিঁকিভাগ। কোন কোন ক্ষেত্রে শূন্যভাগ।

বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষকগণ চরম বৈষম্যের স্বীকার। এ যেন পতিত সরকারের এক চোখে লবন ও অন্য চোখে তেল দেয়ার মত অবস্থা। তেলের মাথায় সবাই তেল দিতে পারে কিন্তু যার মাথায় তেল থাকে না তার মাথায় কেউ তেল দিতে চায় না। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকগণ নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। স্কেল বৈষম্যের স্বীকার, উচ্চতর স্কেল না পাওয়া। এসব বৈষম্য নিরসনে এমপিও নির্দেশিকা অনুযায়ী ১০ বছর ও ১৬ বছর সন্তোষজনক চাকরি শেষে শিক্ষক কর্মচারীগণকে দুটি উচ্চতর গ্রেড প্রদান করা হলেও প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে।

দেশের হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারীগণ আগের নিয়মে টাইম স্কেল পাওয়ার সময় হলেও তারা টাইম স্কেল পাননি জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার কারণে। জাতীয় বেতন স্কেল ৫ বছরেরও আগে হয়েছে। অথচ দীর্ঘদিন থেকে প্রধান সহকারি প্রধান শিক্ষকগণ উচ্চতর গ্রেড বঞ্চিত হচ্ছেন।
এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক যারা প্রথম টাইম স্কেল প্রাপ্তি থেকে (১০+৬) পরবর্তী ছয় বছর একই স্কেলে চাকরি করেছেন, নীতিমালা অনুযায়ী তারা উচ্চতর স্কেল পাচ্ছেন। অর্থাৎ তারা জাতীয় বেতন স্কেলের ৯ম গ্রেড থেকে ৮ম গ্রেডে উন্নীত হয়েছেন। বেসরকারি এমপিও শিক্ষকদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে একটা বিরাট অর্জন,গর্বের বিষয়।

সহকারী শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল প্রাপ্তির এই সুযোগ অবশ্যই ঐতিহাসিক এবং কাঙ্ক্ষিত। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে। পাশাপাশি ৮ম গ্রেডে উন্নীত উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্ত সকল শিক্ষককে অভিনন্দন জানাই।

এমনিতে বেসরকারি এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের বৈষম্যের শেষ নেই। দেশের প্রায় ৯৮ ভাগ মাধ্যমিক শিক্ষা বেসরকারি নির্ভর হওয়া সত্ত্বেও এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারীদের চেয়ে যোজন যোজন দূরে।

প্রধান সমস্যা হলো, সহকারী শিক্ষকরা একটি টাইম স্কেল প্রাপ্তির পর দ্বিতীয় উচ্চতর স্কেল পাওয়ায় তারা এখন মর্যাদায় সহকারী প্রধান শিক্ষকদের সমতুল্য। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে একজন সহকারী প্রধান শিক্ষকের সাথে উচ্চতর স্কেল প্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকের কিছু দায়িত্বের বেড়াজাল ব্যতিত মূলত আর কোন পার্থক্য নেই। ফলে সহকারী প্রধান শিক্ষকগণ চাকুরী করতে লজ্জা পান। অনেক কটু কথা শুনতে হয়।

কোন এক অজানা কারণে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। এ বিষয়টি শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নজরে আনলে তারাও লা-জবাব। অর্থাৎ এ বিষয়ে তাদেরও ‘জানাশুনা’ নেই। প্রশ্ন হলো, একজন সহকারী শিক্ষক কিংবা কর্মচারী শর্তপূরণ করে উচ্চতর স্কেল প্রাপ্য হতে পারলে প্রতিষ্ঠানের অপরাপর দুই গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী (প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক) তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে, এক দেশে দু আইন চলতে পারে না।

শিক্ষকদের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে গণ্য করা হলেও বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন। তাদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘদিনের এবং তা শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা এবং ন্যায্যতার দাবি আদায়ের জন্য অব্যাহতভাবে চলমান রয়েছে। শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রধান কারণ তাদের বেতন বৈষম্য। এটি একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা, বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। সরকারি এবং বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে এই বৈষম্য প্রকট। যেখানে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা তুলনামূলক ভালো বেতন ও অন্যান্য অনেক সুবিধা পান, কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এই সুবিধাগুলো নেই বললেই চলে। এই বৈষম্য শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে; যা শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে বড় বাধা সৃষ্টি করছে।

সরকারি শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত একটি বেতন কাঠামো রয়েছে; যা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং পদ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এটি জাতীয় বেতন স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি, ইনক্রিমেন্ট, পেনশন সুবিধা, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন; যা তাদের আর্থিক উন্নতির সহায়ক ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

পক্ষান্তরে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য এসব সুযোগ-সুবিধা সাধারণত নেই বললেই চলে। যা তাদের আর্থিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় বেসরকারি শিক্ষকদের অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। বেসরকারি শিক্ষকরা অবসর গ্রহণের পর পেনশন সুবিধা পান না, যা তাদের অবসর জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত করে। এমনকি তাদের জমাকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ও অবসরকালীন ভাতা পেতে বছরের পর বছর পায়ের জুতা ক্ষয় করতে হয়। অনেকে চিকিৎসা অভাবে মৃত্যু বরণ করলেও ওই টাকা পান না। এতে অনেক শিক্ষককে অবসরে এসে বেতন-ভাতাহীন অবস্থায় পথে বসতে হয়। তাদের বরণ করতে হয় বার্ধক্যজনিত এক করুণ জীবন। বেতন বৃদ্ধি ও ইনক্রিমেন্টের ক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষকদের বেতন নির্দিষ্ট সময় অন্তর বৃদ্ধি পেলেও বেসরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এই সুবিধা অনুপস্থিত থাকে। সরকারি চাকরির তুলনায় বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরির স্থায়িত্ব এবং নিরাপত্তা কম। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান জরিপ ২০২৩-এর মতে, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সহকারী শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, প্রভাষক, অধ্যক্ষসহ মোট ৪ লাখ ৩১ হাজার ২৪৪ জন এবং শিক্ষার্থী মোট ১ কোটি ২৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯৩৬ জন। ৪ লাখ ৩১ হাজার ২৪৪ জন এমপিওর মাধ্যমে প্রায় ৯৩০৮ কোটি টাকার বেতন বোনাস পেয়ে থাকেন। শিক্ষার্থীর কোনো আয় সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। কিন্তু মাসে শিক্ষার্থীপ্রতি গড়ে ৩০ টাকা হারে ১২ মাসের ফিস আদায় করলে ৪৪৬ কোটি টাকা এবং ভর্তি ফি ও সেশন ফি-বাবদ বছরে একবার ৫০০ করে নিলে মোট ৬১৯ কোটি টাকা হবে। এতে মোট ১০৬৫ কোটি টাকা প্রায় আদায় করা সম্ভব হবে।

ওই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩১২৪৩টি প্রতিষ্ঠানকে সরকারীকরণ করলে সরকারের ব্যয় হবে ১৫৫১৪ কোটি টাকা। এখানে এমপিওর মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্তি ও শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রাপ্তি ১০৩৭৩ কোটি বাদ দিলে, সরকারের অতিরিক্ত লাগবে বছরে প্রায় ৫১৪১ কোটি টাকা। যদি ১,০০০ কোটি টাকাও লাগে তাহলেও বলা যায় ‘জাতীয়করণ আর্থিক কোনো সমস্যা নয়, প্রয়োজন সদিচ্ছার’। জাতীয়করণের সফলতার জন্য সরকারের সদিচ্ছা, সঠিক পরিকল্পনা, এবং স্বচ্ছতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কাছে বেসরকারী শিক্ষক সমাজের প্রাণের দাবী
একটায় সেটা হলো বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একযোগে জাতীয়করণ করা। এ ঘোষনার অপেক্ষায় শিক্ষক সমাজ তীর্থের কাকের ন্যয় চেয়ে আছে। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের জন্য যে বিনিয়োগ হবে সেটা হবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ, মহৎ, বিনিয়োগ। এ কাজটি করতে পারলে জাতী আপনাদের আজীবন স্মরণ করবেন। লাখ লাখ শিক্ষা পরিবারের সদস্যগণ আল্লাহর নিকট প্রার্থানা করবেন।