• কাদির কল্লোল
    • বিবিসি বাংলা, ঢাকা
    • ১৫ অগাস্ট ২০২২

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় ভারতবর্ষ ভাগের পটভূমি এবং ঘটনাবলী নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে।

অনেকে মনে করেন, একজাতি বা দ্বিজাতি তত্ত্বের মীমাংসা না হওয়ায় এই ভূখণ্ডটি ভারত এবং পাকিস্তান নামে বিভাজন হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে।

সেখানে স্বার্থের বিষয় ছিল ভারতবর্ষের তৎকালীন জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বের। সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগও রয়েছে।

তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরাও সাম্প্রদায়িক চিন্তার ভিত্তিতেই বিভাজন চেয়েছিল বলে বলা হয়ে থাকে।

ভারত বিভক্তি কেন অনিবার্য হয়েছিল

এই প্রশ্নে এখনও নানা আলোচনা বা বিতর্ক রয়েছে।

ভারতবর্ষে সেই ১৯৪৭ সালে জওহরলাল নেহেরু, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং সরদার ভল্লভভাই প্যাটেল সহ কংগ্রেস নেতৃত্ব একজাতির দেশ দাবি করেছিলেন।

তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন বলেছিলেন, “হিন্দু মুসলিমদের একই জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত করা একটা স্বপ্নমাত্র।”

মি: জিন্নাহ তখন দ্বিজাতি তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে ১৯৪০ সালে তিনি লাহোরে এক বক্তৃতায় ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন।

জাতি নিয়ে সমস্যার মীমাংসা না হওয়ার বিষয়টি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের বড় কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক এবং অ্যামিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ব্রিটিশ শাসকেরা আগে থেকেই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারতের বিভাজন চেয়েছিল।

“দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষে তখনকার প্রধান দু’টি দল কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ জাতি সমস্যার সমাধান করতে চায়নি বা তাদের দৃষ্টিতে এটা ছিল না”।

এই দু’টি বিষয়কে বিভাজনের বড় কারণ হিসাবে দেখেন অধ্যাপক চৌধুরী।

তিনি বলেন, “এক জাতির দেশ দাবি করার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল ১৯৪৭ এর ধর্মভিত্তিক বিভাজনের বীজ।”

জাতি সমস্যা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, সে সময় ভারতে ভাষাভিত্তিক ১৭টি জাতি ছিল।

“কিন্তু কংগ্রেস ভারতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে এক জাতি বলেছে। আর মুসলিম লীগ বলেছে দুই জাতি” বলেন অধ্যাপক চৌধুরী।

তিনি মনে করেন, জাতি সমস্যার মীমাংসা করতে না পারার পেছনে বড় কারণ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে এক করে ফেলা হয়েছিল।

“হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুসলিম সম্প্রদায়-তারা দু’টো সম্প্রদায়, তারা কিন্তু দু’টো জাতি নয়”।

“কিন্তু কংগ্রেস প্রথমে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে মনে করলো যে, ভারতবর্ষে একটাই জাতি আছে। তখন প্রশ্ন উঠলো এর ঐক্য নিয়ে।

“মুসলিমরাও বললো, আমরাও একটা বড় সম্প্রদায় এবং আমরাও একটা জাতি” বলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেন, ধর্মের ভিত্তিতে জাতির সংজ্ঞা দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দিক থেকে প্রধান ভূমিকা ছিল কংগ্র্রেসের ভেতরে থাকা হিন্দু মহাসভাপন্থীদের।

“মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য একটা স্বতন্ত্র আবাসভূমি চেয়েছিল। তারা তখন প্রথমে দেশভাগ চায়নি।”

অধ্যাপক চৌধুরী আরও বলেন, “বিশেষ করে বাংলা এবং পাঞ্জাবে মুসলিমদের সংখ্যা বেশি এবং এই দু’টি প্রদেশে মুসলিম লীগের সরকার গঠন করতে হবে।

“বাংলায়তো মুসলিম লীগের সরকার এসেই গিয়েছিল। এটা কংগ্রেসের ভেতরের হিন্দু মহাসভা মেনে নিতে পারে নি।

“ফলে কংগ্রেসের আগ্রহ বেশি ছিল ধর্মের ভিত্তিতে ভাগের ব্যাপারে। তখন মুসলিম লীগও দেখেছে, তাতে তাদেরও ক্ষতি নেই।”

ধর্মের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তানের ভাগের পেছনে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ছিল বলেও মনে করেন অধ্যাপক চৌধুরী।

তিনি বলেন, “কংগ্রেসে শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ছিল। মুসলিম লীগে উঠতি শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরাও তাদের স্বার্থে তারাও চাচ্ছিল না যে ভারত একসাথে থাকুক।”

ব্রিটিশদের ভারত ছাড়ার চিন্তা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময়ই স্পষ্ট হয়েছিল যে, ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে হবে।

তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুনের আগেই তাদেরকে ভারতবর্ষের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

সে সময় তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি হন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি।

তিনি একেবারে ভেতর থেকে দেখেছেন ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের ঘটনাবলী। শেখ মুজিব তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে বর্ননা করেছেন ঘটনাবলীর।

তিনি লেখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় ব্রিটেনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ভারতবর্ষে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন, সেটির নাম ছিল ক্রিপস মিশন। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্লেমেন্ট অ্যাটলি যখন লেবার পার্টির পক্ষ থেকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি ১৯৪৬ সালের ১৫ই মার্চ তিনজন মন্ত্রীর সমন্বয়ে ক্যাবিনেট মিশন পাঠানোর ঘোষণা দেন।

বলা হয়েছিল, এই মিশন ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন দলের সাথে পরামর্শ করে ভারতবর্ষকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাধীনতা দেয়া যায়-সেই চেষ্টা করবে।

জিন্নাহর কনভেনশন

ব্রিটিশ সরকার মিশন পাঠানোর ঘোষণা দিলেও তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মি: অ্যাটলির বক্তব্যে মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির বিষয়ে উল্লেখ ছিল না।

বরং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দাবিকে তিনি কটাক্ষ করেছিলেন।

মি: অ্যাটলির বক্তব্য নিয়ে কংগ্রেসের তৎকালীন নেতৃত্ব সন্তোষ প্রকাশ করলেও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন।

ব্রিটেনের ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালের ২৩শে মার্চ ভারতবর্ষে এসে একটি বিবৃতি দিয়েছিল। সেটাও মুসলামানদের বিচলিত করেছিল।

এই মিশন আসার পর দিল্লিতে ৭ই এপ্রিল থেকে তিন দিনের কনভেনশন ডাকেন মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ।

সেই কনভেশন ডাকা হয় ভারতবর্ষের মুসলিম লীগপন্থী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সদস্যদের জন্য।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ডাকে দিল্লী যাওয়ার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোলকাতা থেকে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছিলেন।

সেই কনভেনশন থেকে মি: জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ১৬ই অগাস্ট ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ বা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

মি: জিন্নাহ এসব তৎপরতার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার এবং ক্যাবিনেট মিশনকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে ভারতবর্ষে তখনকার ১০ কোটি মুসলমান পাকিস্তান দাবি আদায়ে বদ্ধপরিকর।

নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার

ব্রিটেনের ক্যাবিনেট মিশন আসার কয়েকমাস পর ভারতবর্ষে জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হলেও মুসলিম লীগ প্রথমে তাতে যোগ দেয়নি।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি এবং ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ নামে একটি বই লিখেছেন।

তিনি ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন।

মৌলানা আজাদ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, অন্তবর্তী সরকারে প্রথমে অংশ না নিলেও মুসলিম লীগ অনেক আলোচনার পর ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে সেই সরকারে যোগ দিয়েছিল।

তবে ইতোমধ্যে কলকাতা এবং নোয়াখালীসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু- মুসলিম দাঙ্গা হয়।

এমন প্রেক্ষাপটে নতুন ভাইসরয় এবং গভর্নর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে আসেন ১৯৪৭ সালের ২২শে মার্চ।

মৌলানা আজাদ লিখেছেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন নতুন ভাইসরয় ও গভর্নর হওয়ার পর ইংরেজদের মাথায় ভিন্ন চিন্তা আসে এবং তখন থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে থাকে।

যদিও ব্রিটিশ সরকারের ক্যাবিনেট মিশনের লক্ষ্য ছিল পুরো ভারতবর্ষকে অখণ্ড রেখে বিভিন্ন অঞ্চলের অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেয়ার মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীনতা দেয়া।

লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছিলেন ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির তখনকার প্রেসিডেন্ট মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।

লর্ড মাউন্টব্যাটেন মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন, ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তার আগে ভারতবর্ষে চলমান হিন্দু-মুসলমান সংঘাত বন্ধের জন্য একটা পদক্ষেপ নিতে হবে।

মৌলানা আজাদ মি: মাউন্টব্যাটেনকে জানিয়েছিলেন, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যকার মতপার্থক্য অনেক কমে এসেছে।

তখন ব্রিটিশ মিশন ভারত ভাগের ক্ষেত্রে বাংলা এবং আসামকে একত্রে রেখেছিল।

কিন্তু কংগ্রেস এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে। আসাম এবং বাংলা একসাথে থাকবে কীনা- এ নিয়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য শুরু হয়।

দুই পক্ষের মতপার্থক্য এমন একটি জায়গায় পৌঁছায় যে তখন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার প্রয়োজন দেখা দেয়।

মৌলানা আজাদ প্রস্তাব করেছিলেন এ বিষয়টি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের উপর ছেড়ে দিতে।

কিন্তু তখনকার কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার প্যাটেল তাতে রাজী হননি।

এরই মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছিল। কলকাতা দাঙ্গার পর হিন্দু-মুসলমান সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী ও বিহারে।

ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশদের গঠন করা অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু দপ্তর ভাগ করে দেয়া হয়েছিল কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে।

সেই সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রেও দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল।

সরদার প্যাটেল-লিয়াকত আলী খান দ্বন্দ্ব

স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বে থাকা কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেল এবং অর্থ দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খানের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছিল।

কারণ লিয়াকত আলী খানের অনুমোদন ছাড়া সরদার প্যাটেল দাপ্তরিক কোন কর্মকাণ্ড চালাতে পারছিলেন না।

যদিও সরদার প্যাটেল নিজেই নিজের হাতে স্বরাষ্ট্র দপ্তর রেখে লিয়াকত আলী খানকে অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের এই দ্বন্দ্বের পুরো সুযোগ নিয়েছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তিনি ধীরে ধীরে পূর্ণ ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে ভারতের বিভক্তিকেই একমাত্র সমাধান হিসাবে সামনে আনেন।

মৌলানা আজাদের বর্ণনা অনুযায়ী, লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয়পক্ষকে খুশি করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি কংগ্রেসের সিনিয়র নেতাদের মনে পাকিস্তান সৃষ্টির বীজ বপন করেছিলেন।

তখন কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে সরদার প্যাটেলই সবার আগে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ধারণা গ্রহণ করেছিলেন।

একপর্যায়ে সরদার প্যাটেল জনসম্মুখেই বলেছিলেন, মুসলিম লীগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি ভারতবর্ষ ভাগ করতেও রাজি আছেন।

মৌলানা আজাদের বর্ননায়, জওহরলাল নেহেরু প্রথমে এই বিভক্তির পক্ষে ছিলেন না এবং তিনি এ ধরনের ফর্মুলার কথা শুনে প্রথমে ক্ষেপে গিয়েছিলেন।

কিন্তু সরদার প্যাটেল যখন ভারত বিভক্তির ফর্মুলায় রাজি হন, এরপর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ক্রমাগত বোঝাতে থাকেন জওহরলাল নেহেরুকে।

শেষপর্যন্ত নেহেরু রাজি হন

মৌলানা আজাদ তাঁর বইতে দু’টি বিষয় উল্লেখ করেছেন।

প্রথমত, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রীর একটা বড় প্রভাব ছিল জওহরলাল নেহেরুকে ভারত ভাগে রাজি করানোর ক্ষেত্রে।

এছাড়া কৃষ্ণ মেনন নামের আরেকজন ব্যক্তি প্রভাব খাটিয়েছিলেন নেহেরুর ওপর।

ভারতীয় এই ব্যক্তি ছিলেন জওহরলাল নেহেরুর খুবই পছন্দের ব্যক্তি। কৃষ্ণ মেনন ১৯২০ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করতেন।

তিনি ১৯৪৬ সালে যখন ভারতে আসেন, তখন তার মাধ্যমে জওহরলাল নেহেরুর ওপর প্রভাব খাটান লর্ড মাউন্টব্যাটেন।

ভারতবর্ষে অন্তবর্তী সরকার পরিচালনায় জওহরলাল নেহেরুর সাথেও মুসলিম লীগ নেতাদের সম্পর্কে অবনতি হচ্ছিল।

সরকারের থাকা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে ঝগড়া প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এই দ্বন্দ্বও প্রভাবিত করেছিল জওহরলাল নেহেরুকে।

শেষপর্যন্ত যখন সরদার প্যাটেলের সাথে জওহরলাল নেহেরু ভারত ভাগে রাজি হন, তখন হতাশ হয়েছিলেন মৌলানা আজাদ।

শেষ ভরসা ছিল গান্ধী

মৌলানা আজাদ লিখেছেন, সরদার প্যাটেল এবং জওহরলাল নেহেরুকে বোঝাতে ব্যর্থ হবার পর তিনি শেষ ভরসা করেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ওপর।

মৌলানা আজাদ দেখা করেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সাথে। সেই সাক্ষাতে তিনি ভারত ভাগের পক্ষে অবস্থান না নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

তবে কয়েকদিন পর মি: গান্ধী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে দেখা করেছিলেন। এরপর সরদার প্যাটেল মি: গান্ধীর সাথে দেখা করে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেছিলেন।

এসব বৈঠকের পর মৌলানা আজাদ আবার যখন মি: গান্ধীর সাথে দেখা করেন, তখন তাঁর মনে হয়েছে, মি: গান্ধীর অবস্থান বদলে গেছে।

তবে পরে মি: গান্ধী মৌলানা আজাদকে জানিয়েছিলেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে তাঁর পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে সরকার গঠনের ব্যাপারে মি: গান্ধী প্রস্তাব করেছেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেনও তাতে রাজি আছেন।

শেষপর্যন্ত সরদার প্যাটেল এবং জওহরলাল নেহেরু এর বিরোধীতা করে মি: গান্ধীকে সেই প্রস্তাব প্রত্যাহারে বাধ্য করেন।

তখন মি: গান্ধী মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন, ভারতবর্ষের বিভক্তি অনিবার্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কীভাবে ভাগ হবে।

মৌলানা আজাদ রাজি না থাকলেও কংগ্রেসের বাকি নেতৃত্ব ভারত ভাগের ফর্মূলা গ্রহণ করেছে।

কংগ্রেস নেতৃত্বের অবস্থান পক্ষে পাওয়ার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন লন্ডন গিয়েছিলেন।

মৌলানা আজাদ লিখেছেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারকে বোঝাতে গিয়েছিলেন বলে তার ধারণা।

লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের ৩০শে মে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন এবং ২রা জুন তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে বৈঠক করেন।

এরপর ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন মি: মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনার ‘হোয়াইট পেপার বা শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করেন। সেই শ্বেতপত্রে ছিল ভারত বিভক্তির রুপরেখা।

ব্রিটিশ সরকারের সেই ঘোষণার মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান নামে ভারতবর্ষের বিভক্তি চূড়ান্ত রুপ নেয়।

মৌলানা আজাদের বিশ্লেষন হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকার ভেবেছিল ভারতবর্ষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা হলে অর্থনৈতিকভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হবে ।

ফলে ভারতবর্ষ ভাগের পেছনে ভারতীয়দের চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থ বেশি প্রধান্য পেয়েছে।

ম্যাপে লাইন টেনে সীমান্ত ভাগ

ব্রিটিশ সরকার তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারত ভাগের সীমানা ঠিক করার জন্য সিরিল র‍্যাডক্লিফ নামের একজন ব্রিটিশ আইনজীবীকে দায়িত্ব দিয়েছিল।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতকে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করার জন্য ঐ আইনজীবীকে কাগজে কলমে পাঁচ সপ্তাহের সময় দেয়া হয়েছিলো।

আইনজীবী সিরিল র‍্যাডক্লিফ ম্যাপের ওপর লাইন টেনে যে সীমানা ভাগ করেছিলেন বা যে সীমানা তিনি এঁকেছিলেন, সেটিকে এখনও এই উপমহাদেশে উত্তেজনার মূল কারণ হিসাবে দেখা হয়।

সীমানা লাইনটি র‍্যাডক্লিফ লাইন নামেই পরিচিতি পায়।

হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান, এভাবে ভারতবর্ষ ভাগ হয়।

ভারতবর্ষে তখন ৪০ কোটি মানুষের বসবাস ছিল বলে ধারণা করা হয়।

তবে পূর্বদিকে বাংলা এবং পশ্চিম দিকে পাঞ্জাব- ব্রিটিশ শাসিত ভারতে এই দু’টি বড় প্রদেশে মুসলিম এবং অমুসলিমদের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি ছিল।

এই দু’টি প্রদেশের মধ্যে লাইন টেনে সীমানা ভাগ করার দায়িত্ব ছিল র‍্যাডক্লিফের।

তাঁকে এই জটিল কাজের জন্য নির্ভর করতে হয়েছে একটি পুরোনো ম্যাপ, জনসংখ্যার ভুল চিত্র সম্বলিত তথ্যের ওপর।

একইসাথে আইনজীবী নির্ভর করেছিলেন কিছু অনড় উপদেষ্টার ওপর।

শত বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে, এমন কোন সম্প্রদায়কে সোজা লাইন টেনে বিভক্ত করা কতটা ঝুঁকির কাজ ছিল-সেটা র‍্যাডক্লিফ নিজেও জানতেন। তখন এনিয়ে উত্তেজনাও ছিল চরমে।

সেজন্য ভারত পাকিস্তানের স্বাধীনতার কয়েকদিন পর লাইন টেনে সীমান্ত ভাগ করার র‍্যাডক্লিফের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছিলো।

ফলে মানুষ যখন ব্রিটিশ থেকে স্বাধীন হওয়ার আনন্দ উদযাপন শুরু করেছিল, তখন তারা জানতেন না যে তারা ঠিক কোন দেশের অধিবাসী হতে যাচ্ছেন।

প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে র‍্যাডক্লিফ লাইন নামে পরিচিতি পাওয়া সেই সীমান্ত লাইন অতিক্রম করে এপার-ওপার করতে হয় নিজের বসবাসের জন্য।

তখন শুরু হয় ধর্মীয় সহিংসতা এবং সেই সহিংসতায় প্রাণ হারায় ৫লাখ থেকে ১০ লাখ মানুষ।

সেটি ছিলো ভয়াবহ রক্তাক্ত এক ট্রাজেডি। এখনও সেই সীমান্ত লাইন রক্তাক্ত করে চলেছে ভারত পাকিস্তান সম্পর্ককে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর: হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী আর মুজিব, যে চার নেতা বদলে দিলেন ভারত-ভাগ পরবর্তী পূর্ব বাংলার রাজনীতি

 

  • মিজানুর রহমান খান
  • বিবিসি বাংলা, লন্ডন
  • ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

পাকিস্তানের জন্মের পর প্রথম এক দশক ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। এই সময়ের রাজনীতিতে এমন সব ঘটনা ঘটেছে যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, পাকিস্তান ভেঙে গিয়ে এক সময়ে যে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম হবে দেশটির সূচনালগ্নেই তার ক্ষীণ কিছু আভাস পাওয়া গিয়েছিল এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কিছু প্রস্তুতিও হয়ে গিয়েছিল সেই সময়ে।

হিন্দু মুসলিম এই দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট। এই জন্ম ছিল মূলত মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল। কিন্তু এর পরেই দেশটির রাজনীতিতে অভাবনীয় কিছু ঘটনা ঘটে যার একটি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি মুসলিম লীগের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।

পাকিস্তানের জন্ম: লাহোর প্রস্তাব থেকে শুরু

পাকিস্তানের জন্মের বীজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলনে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবকে। এই প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।

বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতা এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এই প্রস্তাবটি পেশ করেন। পরে এই লাহোর প্রস্তাব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে বিবেচিত হয়।

এর মাত্র ছয় বছর পর ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভাজন আরো স্পষ্ট হয়। মুসলিম এলাকায় মুসলিম লীগের প্রার্থী এবং হিন্দু এলাকায় কংগ্রেসের প্রার্থীরা জয়ী হয়।

মূলত মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতেই মুসলমানরা দলে দলে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে সেসময় মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছিল।

লর্ড মউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করেন যে ব্রিটিশ সরকার দেশ বিভাগের নীতি মেনে নিয়েছে,এবং ১৪ই অগাস্ট তারা শাসনভার ছেড়ে দিলে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তানের।

ভারতকে মাঝখানে রেখে পাকিস্তানের ছিল দুটো অংশ- পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান। পরের এক দশক ধরে পূর্ব পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল পূর্ব বাংলা। কিন্তু জন্মের পর থেকে একই দেশের এই দুটো অংশের মধ্যে বৈষম্য ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে।

রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ: উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ গ্রন্থে লিখেছেন: “বাঙালি মুসলমান পরিচিত প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে এক রাষ্ট্রে বসবাস করবে না, এই লক্ষ্য নিয়ে অপরিচিত দূরবর্তী অঞ্চলের মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকিস্তান বানাল। তবে মোহভঙ্গ হতে দেরি হলো না।”

স্বপ্নভঙ্গ: এই পাকিস্তান আনলেন?

মুসলিম লীগের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ঠিকই কিন্তু খুব শীঘ্রই পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি মুসলিম লীগের হাতছাড়া হয়ে গেল। সূচনা হলো নতুন এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “পাকিস্তান যে স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল যে সেই স্বপ্ন সুদূর পরাহত।”

এর পরের কয়েক বছরে “মানুষ যে অবস্থার মধ্যে পড়লো সেই অবস্থা একাধিক কারণে অত্যন্ত সংকটাপন্ন ছিল। প্রায় দুর্ভিক্ষের অবস্থা হয়েছিল, অর্থনীতিও ভেঙে পড়েছিল। আরেকটি হল রাষ্ট্রভাষার সমস্যা,” বলেন মি. চৌধুরী।

তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তখন থকেই অন্য এক পথ তৈরি হতে শুরু করে।

শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে এরকম স্বপ্নভঙ্গের বহু ঘটনার উল্লেখ আছে। তার একটি এরকম: সেসময় মুসলিম লীগের নেতার নামে ‘জিন্নাহ ফান্ড’ নামে সরকার একটি ফান্ড খুলেছিল। তাতে যে যা পরে দান করার কথা থাকলেও কোথাও কোথাও জোরপূর্বক টাকা তোলা শুরু হয়।

শেখ মুজিব নৌকায় করে গোপালগঞ্জে যাওয়ার সময় মাঝির সাথে তার কথাবার্তা নিয়ে তিনি লিখেছেন, ” নৌকা ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলে, ‘ভাইজান আপনি এখন এসেছেন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। পাঁচজন লোক আমরা, হুকুম এসেছে পাঁচ টাকা দিতে হবে। দিনভর কোনদিন দুই টাকা, কোনোদিন আরও কম টাকা উপার্জন করি, বলেন তো পাঁচ টাকা কোথায় পাই? গতকাল আমার বাবার আমলের একটা পিতলা বদনা ছিল, তা চৌকিদার টাকার দায়ে কেড়ে নিয়ে গেছে।’ এই কথা বলে কেঁদে ফেলল…শেষে বলে, ‘পাকিস্তানের কথা তো আপনার কাছ থেকেই শুনেছিলাম, এই পাকিস্তান আনলেন!”

ভাষা আন্দোলনের সূচনা

পাকিস্তানের জন্মের আগে থেকেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার রাজনীতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। এর কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পাকিস্তানে মুসলিম লীগের কার্যকলাপে হতাশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম তরুণরা ততদিনে সংগঠিত হওয়া শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি। আহবায়ক কমিটির মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন।

পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোন ভাষা নয়।

গবেষকরা বলছেন, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে মানুষ মুসলিম লীগের প্রতি আরো বেশি বিরূপ হয়ে পড়ে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “জিন্নাহ সাহেবের ঘোষণায় মধ্যবিত্ত, যে মধ্যবিত্ত রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল, তারা দেখলো যে এরকম হলে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে। যারা উর্দু জানে তারা তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। আগে তারা কোনরকমে ইংরেজি শিখেছিল। এখন তাদেরকে উর্দু শিখতে হবে। ফলে মধ্যবিত্ত খুব হতাশ হয়ে পড়লো। এবং তখন থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়ে গেল।”

এই আন্দোলনের প্রথম ধাপটি ছিল সরকারি দল মুসলিম লীগের বিরোধী দল হিসেবে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব।

আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম

মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করলেও পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে তখনও পর্যন্ত ছিল দলটির একচেটিয়া দাপট।

এর মধ্যে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আসাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় চর ভাসানে দীর্ঘ সময় মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন। এজন্য তিনি ভাসানী নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

মুসলিম লীগ সরকারের ভয়ভীতি ও নির্যাতন উপেক্ষা করে তিনি নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “মওলানা ভাসানী যে পাকিস্তান চেয়েছিলেন সেটা না পেয়ে তিনি আন্দোলনে নেমে পড়লেন এবং তাকে কেন্দ্র করেই আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হল। তিনি সভাপতি হলেন।”

নতুন দল গঠনের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে বসবাসরত পূর্ব বাংলার আরেক জনপ্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং কলকাতা ফেরত যুবক শেখ মুজিবুর রহমান।

উনিশ’শ উনপঞ্চাশ সালের ২৩শে জুন গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। আওয়ামী লীগ নামটি দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী যার অর্থ জনগণের মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের অগ্রগণ্য অনেক নেতা নতুন দলে যোগ দেন। জেলে আটক থাকলেও শেখ মুজিব হলেন যুগ্ম সম্পাদক।

রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “জেলে আটক অবস্থায় দলের একটি উঁচু পদে তার নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে এটা অনুমান করা যায়, তাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক হিসেবে মনে করা হতো।”

আওয়ামী মুসলিম লীগ পরিচালনার ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন শেখ মুজিব। সোহরাওয়ার্দী তাকে খুব স্নেহ করতেন- পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন, জামা কাপড় কিনে দিতেন। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলায় এলে শেখ মুজিব সব সময় তার সহযোগী হতেন।

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। পাঁচ দশক পরে এই দলটির রাজনৈতিক নেতৃত্বে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে জন্ম হয় বাংলাদেশের।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন ধরনের রাজনীতির সূচনা ঘটে, উন্মেষ হয় ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির।

“নতুন দলটি দুটো বিষয়কে ধারণ করলো: একটা হচ্ছে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিক্ষোভ, সেটা রাজনীতিকদের মধ্যে, আবার মধ্যবিত্তের মধ্যে বিক্ষোভ তৈরি হলো কারণ তারা দেখলো যে সরকার পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য তৈরি হয়েছে এবং সেখানে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব নেই।”

তিনি বলেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ কতো দূর যাবে সেটা প্রথমে বোঝা যায়নি। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর দলটি অনেক দূর এগিয়ে গেল।

আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সময় ও পরে শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ সময় কারাগারে আটক ছিলেন। যখন জেল থেকে বের হয়ে এলেন তখন মওলানা ভাসানীসহ তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা জেলে বন্দী। এসময় তিনি সোহরাওয়ার্দীকে সাথে নিয়ে পূর্ব বাংলার জেলায় জেলায় ঘুরে সংগঠন গড়ে তুলেন।

শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন: “এই সময় প্রায় প্রত্যেকটা মহকুমায় ও জেলায় আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ে উঠেছে। শহীদ সাহেবের সভার পরে সমস্ত দেশে এক গণজাগরণ পড়ে গেল। জনসাধারণ মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ দলে যোগদান করতে শুরু করেছিল।”

রাজনৈতিক ভাষ্যকার মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, “শেখ মুজিবের বয়স তখন ৩২ বছর। দেশের আনাচেকানাচে ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে মেশা, কর্মী সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করা এবং প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী সংগঠনকে মাঠ-পর্যায়ে বিস্তৃত করার গুরুদায়িত্ব তাঁকেই বহন করতে হয়েছিল। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন দলের প্রাণপুরুষ।”

ইত্তেফাকের প্রকাশনা: আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুখপত্র’

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইত্তেফাকের প্রকাশনা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ এক পর্যায়ে পত্রিকাটি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রধান প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয়। আর কোন পত্রিকায় মুসলিম লীগের খবর প্রকাশিত না হলেও ঠাই পেত ইত্তেফাকের পাতায়।

নবাবপুর রোড থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয়, অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতো, এবং এক পর্যায়ে এটি বন্ধ হয়ে যায়।

পরে ১৯৫১ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সম্পাদনায় আবার সাপ্তাহিক হিসেবে ছাপা হতে শুরু করে। এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ছাপা হতো।

দৈনিক হিসেবে ইত্তেফাকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৩ সালে। তখন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ছাপা বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটি চালানোর খরচ দিতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “তিনি ইত্তেফাক চালাতেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ওকালতি করে যত টাকা পেতেন এর একটা বড় অংক ইত্তেফাকের পেছনে খরচ করতেন।”

পত্রিকাটি পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছিল যার চেয়ারম্যান ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিবুর রহমানও ওই বোর্ডের সদস্য ছিলেন। পত্রিকাটি চলানোর ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের কাছ থেকেও অর্থ সংগ্রহ করে দিতেন।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতাদের ওপর পাকিস্তান সরকারের নির্যাতনের সংবাদ পত্রিকাটিতে নিয়মিত প্রকাশিত হতো যা আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে সাহায্য করে।উনিশ’শ বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন এবং আরো পরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়েও ইত্তেফাকের ভূমিকা ছিল।

২১শে ফেব্রুয়ারি: মস্ত বড় পরিবর্তন

পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হলেও তা উত্তাল হয়ে ওঠে ১৯৫২ সালে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।

এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যাতে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগেরই প্রাধান্য ছিল।

আন্দোলন দমন করতে ২০শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পরদিন ২১ ও ২২শে ফেব্রুয়ারি আইন অমান্য করে মিছিল বের করলে পুলিশ গুলি চালায় এবং তাতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়।

এই ঘটনায় পাকিস্তানের রাজনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খায়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ছিল দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তির ওপর তৈরি। তার প্রধান উপাদান ছিল ধর্ম। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন রাজনীতির ক্ষেত্রে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করলো। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তার প্রধান উপাদান হল ধর্মনিরপেক্ষতা। ফলে বাঙালি মধ্যবিত্ত পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করলো। এটা ছিল মস্ত বড় পরিবর্তন।”

ভাষা আন্দোলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং এ কে ফজলুল হক এদের তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। তখন মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব তরুণ কর্মীদের সামনে চলে আসেন।

যুক্তফ্রন্ট গঠন: মুসলিম লীগ ঠেকাও

পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় ১৯৫২ সালে। তার পর থেকেই নিশ্চিত হয়ে যায় যে অচিরেই পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এই নির্বাচনকে সামনে রেখেই ১৯৫৩ সালে গড়ে ওঠে যুক্তফ্রন্ট। এই জোট গঠনে প্রধান ভূমিকা ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির প্রধান এ কে ফজলুল হকের।

যুক্তফ্রন্টের সভাপতি হন পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহওরাওয়ার্দী।

পাকিস্তানের জন্মের পর রাজনীতিতে ছিলেন না ফজলুল হক। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এটর্নি জেনারেল) হিসেবে চাকরি করতেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং কিছু দিনের জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগেও যোগ দান করেছিলেন। কিন্তু দলাদলির কারণে থাকতে পারেন নি। এসময় তিনি তার পুরনো দল কৃষক-প্রজা পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করে গঠন করেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি।

সোহরাওয়ার্দী করাচীতে বসবাস করলেও নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে এসে যুক্তফ্রন্টের সভা সমাবেশে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। বাঙালিদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল। পাকিস্তান গণপরিষদে বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন তিনি। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা তাকে “ভারতের দালাল” বলে প্রচারণা চালিয়েছিল।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “প্রধানত এটা ছিল নির্বাচনী জোট। মুসলিম লীগকে ঠেকানোই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু তার ভেতরে মানুষের হতাশা, ক্ষোভ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এসব কিছু যুক্ত হলো। এর মধ্যে ছিল পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতাও।”

একচেটিয়া বিজয়: মুসলিম ভোটারে উল্টো স্রোত

নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্টের ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়। এই নির্বাচনী ইশতেহার ছিল ২১ দফার যাতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পরিষ্কার রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল। এতে আরো ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটি ঘোষণা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন এই প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। “তিনি মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করেছিলেন। কৃষক সমিতি, মৎস্যজীবী সমিতি, তাতই সমিতি, অটো রিকশা সমিতি এসব গঠন করেন। সংগঠিত করেন শ্রমিকদের।”

“শেখ মুজিবের সাংগঠনিক ক্ষমতারও বড় ভূমিকা ছিল। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ,” বলেন মি. চৌধুরী।

এসময় শেখ মুজিব এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিতে পরিণত হন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন: “আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বললো, ‘বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।’ আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমরা সামনে ধরে বললো, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এল।”

নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে। নৌকা প্রতীক নিয়ে নিরঙ্কুশ জয় পায় যুক্তফ্রন্ট। ২৩৭টি মুসলিম আসনের এই জোটের প্রার্থীরা ২২৮টি আসনে জয়ী হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন।

শেখ মুজিব লিখেছেন, “দুনিয়ার ইতিহাসে একটা ক্ষমতাসীন দলের এভাবে পরাজয়ের খবর কোনোদিন শোনা যায় নাই। বাঙালিরা রাজনীতির জ্ঞান রাখে এবং রাজনৈতিক চেতনাশীল। এবারও তারা তার প্রমাণ দিল।”

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল গ্রামের মানুষের কাছে ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মতো একটি সংগঠিত রাজনৈতিক দল। এ কে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী একটি অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে প্রচারে নামার ফলে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পেছনে আরো একটি কারণ ছিল দুর্ভিক্ষ ও বন্যা। কিন্তু এবিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন তৎপরতা মানুষের চোখে পড়েনি যা পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যে ব্যাপারে মানুষের চোখ খুলে দিয়েছিল।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ একচেটিয়া জয়লাভ করেছিল। সব মুসলিম ভোট তখন পাকিস্তানের পক্ষে পড়েছে। ওই নির্বাচনে মানুষ যেমন স্রোতের মতো গিয়ে ভোট দিয়েছে তেমনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও মানুষ স্রোতের মতো ভোট দিল। কিন্তু এবারের স্রোত গেল উল্টো দিকে। কারণ পাকিস্তান তাদের কিছুই দেয়নি। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হয়ে যাবে এই ভয়ও তাদের মধ্যে কাজ করছিল।”

পূর্ব পাকিস্তানে নতুন সরকার: জন্মেই হোচট

নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। মুখ্যমন্ত্রী হন এ কে ফজলুল হক। এই সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সরকার ৩রা এপ্রিল থেকে ৩০শে মে এই অল্প কিছু দিন স্থায়ী হয়েছিল।

রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ফজলুল হক করাচীতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে সমস্ত ফ্লাইট ভারত হয়ে আসতো। ফেরার পথে তিনি কলকাতায় কয়েকদিন ছিলেন। সেখানে তিনি একটি জনসভায় ভাষণ দেন। বলেন পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গে আমাদের একই সংস্কৃতি একই ইতিহাস একই ঐতিহ্য। আমাদের আলাদা করে রাখা যাবে না। তখন তার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ আনা হয় এবং পূর্ব বঙ্গের মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করা হয়।”

এর পর ফজলুল হক গৃহবন্দী হন। শেখ মুজিবকে আটক করে আবার পাঠানো হয় জেলে।

ভেঙে যায় যুক্তফ্রন্ট।

মওলানা ভাসানী এসময় এক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে ইউরোপে ছিলেন। তার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কয়েক মাস বিদেশে অবস্থানের পর কলকাতায় কিছু দিন থেকে তিনি ফিরে যান ঢাকায়।

উনিশ’শ পঞ্চান্ন সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। মওলানা ভাসানী দলকে অসাম্প্রদায়িক করে তোলার জন্য এই প্রস্তাব দেন এবং কাউন্সিলররা তা সমর্থন করেন।

মওলানা ভাসানী সভাপতি ও শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দলটি সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রিক হওয়ায় আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় শেখ মুজিবের হাতে।

উনিশ’শ ছাপ্পান্ন সালে পাকিস্তানে নতুন সংবিধান চালু হলে পূর্ব বাংলার আনুষ্ঠানিক নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান।

সেবছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পদত্যাগ করলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।