প্রাচীনকাল থেকে রেশমের জন্য রাজশাহী বিখ্যাত। মাঝে ঐতিহ্য হারাতে বসেছিল এ রেশমশিল্প। বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ইনস্টিটিউটের হাত ধরে সেই রেশম আবার স্বপ্ন দেখাচ্ছে সুদিনের। যদিও রাজশাহীর রেশমশিল্প এখন চলছে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত রেশম সুতার ওপর ভর করে। রেশমের নতুন জাত উদ্ভাবনে দেশে রেশম সুতার উৎপাদন বাড়বে, বিদেশনির্ভরতা কমবে। এমন আশা করছেন গবেষকরা। গবেষণায় নিয়োজিত এই প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি রেশমের ৩৫টি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ১৫টি মালবেরি তুত গাছ ও ২০টি রেশম কীট। গবেষকরা বলছেন, নতুন জাতে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ উৎপাদন বেশি হবে। এতে চাষিরাও লাভবান হবেন।
রাজশাহীতে অবস্থিত বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, রেশমশিল্পের উন্নয়নে পাঁচ বছর আগে ‘রেশমপ্রযুক্তি উন্নয়ন বিস্তার ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় রেশম বোর্ড। গত জুনে শেষ হয়েছে প্রকল্পটি। প্রায় ৩৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে রেশমে যুক্ত হয়েছে ১৫টি মালবেরি (তুত) জাতের গাছ ও ২০টি নতুন জাতের রেশম কীট। ফলে বর্তমানে মালবেরি জাতের রেশম গাছের সংখ্যা ৩৮টি ও রেশম কীটের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৪টিতে।
রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদ ও রুমানা ফেরদৌস বিনতে রহমানের যৌথ গবেষণায় নতুন এসব জাত উদ্ভাবন হয়েছে। নতুন ৩৫টি জাত উদ্ভাবনের ফলে বর্তমানে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রাজশাহীতে জার্মাপ্লাজম ব্যাংকে তুত জাতের সংখ্যা ৬০ থেকে ৮৪ ও রেশম কীট জাতের সংখ্যা ৮৫ থেকে ১১৪টিতে উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি উচ্চফলনশীল রেশম কীটের জাত রয়েছে। আরও জানান, নতুন ২০টি রেশম কীট উদ্ভাবনের ফলে প্রতি ১০০টি রোগমুক্ত ডিমে ৭০ থেকে ৭৫ কেজি রেশমগুটি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। আগে এই পরিমাণ ছিল ৬০ থেকে ৬৫ কেজি। এ ছাড়া উচ্চফলনশীল ১৫টি তুতজাত উদ্ভাবনের ফলে বছরে হেক্টরপ্রতি তুতপাতার উৎপাদন ৪০ থেকে ৪৭ টনে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। এর আগে প্রতি হেক্টরে তুতপাতার সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৩০ থেকে ৩৭ টন। ফলে স্বল্প সময়ে ও অল্প ব্যয়ে মানসম্পন্ন কাঁচা রেশম সুতা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। গবেষণা কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদ বলেন, একটি নতুন জাত বের করতে দশ বছর লেগে যায়। এই গবেষণার কাজ আগেই কিছুটা এগিয়ে রাখায় পাঁচ বছরের মধ্যেই শেষ করা সম্ভব হয়েছে। রাজশাহী রেশম গবেষণা ইনস্টিটিউটে জার্মাপ্লাজম থেকে গবেষণার মাধ্যমে নতুন এই ১৫টি জাতের মালবেরি তুতগাছের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিএসআরএম-৬৪, বিএসআরএম-৬৫ ও বিএসআরএম-৭৪ জাতের ট্রায়াল শেষ হয়েছে। এসব নতুন জাত চাষিদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। বাকি জাতগুলো ট্রায়াল শেষে অবমুক্ত করা হবে। এ গবেষক আরও বলেন, প্রকল্পটি দ্বিতীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণের জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকি জাতগুলোর ট্রায়াল শেষ হবে। এগুলো থেকে হেক্টরপ্রতি তুতপাতার উৎপাদন ৪০ থেকে ৪৭ টনে উন্নীত করা সম্ভব হবে। রুমানা ফেরদৌস বিনতে রহমান বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্ভাবিত ২০টি নতুন রেশম কীটের সবগুলোই এখন ট্রায়াল পর্যায়ে আছে। এগুলো চাহিদা অনুযায়ী রেশম সম্প্রসারণের মাধ্যমে ক্রস হাইব্রিড জাত উৎপাদন করে চাষিদের মাঝে সরবরাহ করা হবে। বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট পরিচালক কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, রেশমের উৎপাদন বাড়াতে প্রধান ফসল হিসাবে চাষিদের তুত চাষ করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এখন বাড়ির আশপাশে, রাস্তার ধারে পরিত্যক্ত জায়গায় বেশিরভাগ তুত চাষ হয়। রেশম গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকেও তুত চাষকে জনপ্রিয় করতে সাথী ফসল প্রবর্তন করা হয়েছে। চাষিরা এভাবে চাষাবাদ করলে বেশ লাভবান হবেন। আর কিছু জাতের কাজ এখনো চলছে। এগুলো শেষ হলে এই ৩৫টি নতুন জাত রেশম সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে চাষিদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী রেশম কারখানা ২০০২ সালে বন্ধ করে দেয় তৎকালীন জোট সরকার। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার সচলের উদ্যোগ নিয়ে ২০১৮ সালে কারখানাটি চালু হয়। সে সময় রেশমের সুদিন ফেরাতে ১৫৩ কোটি টাকার চারটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এরপর ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি পায় রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী রেশম। স্বীকৃতি পাওয়ার পর রেশমি বস্ত্রের চাহিদা বহুগুণ বেড়েছে।