ফৌজিয়া কামরুল তানিয়া। রূপালী ইন্স্যুরেন্স ও সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক পদে আসীন। এ তথ্য গোপন করে মেয়েকে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বানাতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বরাবর আবেদন করেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস। অথচ বিমা আইন অনুযায়ী, কোনো মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা যদি অন্য কোনো বিমা কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিচালক, স্পন্সর বা বিমাকারীর ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন, তবে তিনি উক্ত পদে থাকার অযোগ্য হবেন।
এ ধরনের অপরাধ করলেও তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আইডিআরএ। তবে আইনের ‘উদ্ভট’ ব্যাখ্য দিয়ে ফৌজিয়ার নিয়োগ নামঞ্জুর করেছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
বিমা আইন অনুযায়ী- মিথ্যা তথ্য দেওয়ার শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। কিন্তু বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইন অনুযায়ী এ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে আইনের অন্য ধারা উল্লেখ করে ফৌজিয়ার সিইও নিয়োগের আবেদন নামঞ্জুর করেছে। অথচ আইনের ওই ধারায়, আইডিআরএ নয়, কোম্পানির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস আবেদনপত্রের কোথাও ফৌজিয়া রূপালী ইন্স্যুরেন্স ও সোনালী লাইফের পরিচালক থাকার তথ্য উল্লেখ করেননি। ফৌজিয়া এই দুই বিমা কোম্পানির পরিচালক পদে থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) রিপোর্টে।
ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া রূপালী ইন্স্যুরেন্সে যোগ দেন ৪ অক্টোবর ২০০৭ সালে। ১ এপ্রিল ২০০৯ সালে জেনারেল ম্যানেজার, ২০১১ সালে সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার, ২০১৪ সালে সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ২০১৮ সালে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৯ সাল থেকে কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আছেন।
গত জুলাই মাসে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়াকে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ অনুমোদন দিতে আবেদন করেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস। এরপর চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আইডিআরএ থেকে ফৌজিয়ার নিয়োগ অনুমোদনের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়।
আবেদন নামঞ্জুর করে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানকে পাঠানো আইডিআরএ’র চিঠিতে বলা হয়, ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া রূপালী ইন্স্যুরেন্স ও সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২ এর ‘৭জ’ অনুযায়ী- কোনো মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা যদি অন্য কোনো বিমা কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিচালক, স্পন্সর বা বিমাকারীর ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন, তবে তিনি উক্ত পদে থাকার অযোগ্য হবেন।
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২ এর ‘৭জ’ অনুসারে তার নিয়োগ নামঞ্জুর করা হলেও এই ধারায় বলা হয়েছে- বিমা কোম্পানি কোনো মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে অপসারণ করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণক সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়।
কিন্তু যেসব কারণে বিমা কোম্পানি অপসারণ করতে পারবে, সেসব কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিয়োগ অনুমোদনের আবেদন নামঞ্জুর করতে পারবে এমন বিষয় উল্লেখ নেই এই ৭জ ধারায়। ফলে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার নিয়োগ অনুমোদনের আবেদন যে ধারায় নামঞ্জুর করা হয়েছে তা আইনের অপব্যাখ্যা কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এদিকে মুখ্য নির্বাহীর আবেদনে দাখিল করা ফৌজিয়ার জীবনবৃত্তান্তে পরিচালক পদে থাকার কোনো তথ্য নেই। অপরদিকে সোনালী লাইফের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে ফৌজিয়া ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে থাকলেও রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক হিসেবে আছেন এমন কোনো তথ্য নেই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটির বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে।
ফৌজিয়ার রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক পদে থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে তার সিআইবি রিপোর্টে। অর্থাৎ, রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক পদে থাকার তথ্য গোপন করে বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুখ্য নির্বাহী পদে আবেদন করেছেন ফৌজিয়া।
বিমা আইন ২০১০ এর ১৩১ ধারায় দলিল, বিবরণী, হিসাব, রিটার্নে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি মিথ্যা তথ্য দিলে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন অথবা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এছাড়া বিমা আইনের ৭৮ ধারা অনুযায়ী, পরিচালক পদে থাকলে সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানিতে চাকরির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইন লঙ্ঘন করে পরিচালক পদে থাকা ও চাকরি করার দায়েও ফৌজিয়ার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তথ্য গোপন করে পরিচালক পদে থাকা অবস্থায় চাকরি করলে তা অভিজ্ঞতা হিসেবে গণ্য হবে কি না সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি আইডিআরএ।
এদিকে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের একের অধিক পরিচালক থাকলে পরিবারের অন্য সদস্যকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ বা নবায়নের জন্য প্রস্তাব করা যাবে না। ২০২১ সালের ৩১ মে এ নির্দেশনা জারি করে আইডিআরএ। বিমা আইন ২০১০ এর ২(১৮) অনুযায়ী ‘পরিবার’ অর্থ স্বামী বা স্ত্রী, বাবা, মা, পুত্র, কন্যা, ভাই ও বোন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সবাই অন্তর্ভুক্ত হবে।
ফৌজিয়ার বাবা মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস রূপালী ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান বা পরিচালক। তার মা, বোন ও বোন জামাতাও কোম্পানিটির পরিচালক পদে রয়েছেন। ফলে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদ ফৌজিয়াকে কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করার আবেদন করতে পারে না। আইডিআরএ’র এ নির্দেশনা অনুসারেও ফৌজিয়ার আবেদন নামঞ্জুর করেনি আইডিআরএ।
বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানামালা ২০১২ এর প্রবিধি ৫ এ মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ লাভের জন্য প্রার্থীর অযোগ্য শীর্ষক শিরোনামে ছয়টি অযোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। এ ছয়টি অযোগ্যতার মধ্যে পরিচালক পদে থাকাকে অযোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি।
অপরদিকে ৭ প্রবিধিতে বলা হয়েছে সাতটি কারণে একজন মুখ্য নির্বাহীকে অপসারণ করতে পারবে সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানি। যার মধ্যে প্রবিধি ‘৭জ’-তে বলা হয়েছে, অন্য কোনো বিমা কোম্পানির বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিচালক, স্পন্সর বা বিমাকারীর স্বার্থে সংশ্লিষ্ট হন।
অপসারণ করার ক্ষেত্রে আরও শর্ত দেওয়া হয়েছে বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২ প্রবিধি ৭ এর (২)(৩)(৪) ও (৫) উপধারায়। এসব প্রবিধিতে বলা হয়েছে, মুখ্য নির্বাহীকে অপসারণ করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। এরপর তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দাখিল করবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ১৫ দিনের মধ্যে তার প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে অপসারণের সিদ্ধান্ত দেবে।
বিমা খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপসারণ ও অযোগ্যতা ভিন্ন বিষয়। এ কারণে প্রবিধানমালায় দুটি আলাদা প্রবিধি দেওয়া হয়েছে। বিমা কোম্পানি চাইলে পরিচালক পদে থাকার জন্য অপসারণ করতে পারবে। আর যোগ্যতা না থাকার কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমোদনের আবেদন নামঞ্জুর করতে পারে। এক্ষেত্রে অপসারণের কারণ অযোগ্যতা হতে পারে না। আর ৭ প্রবিধি অনুসারে মুখ্য নির্বাহীকে অপসারণের জন্য বিমা কোম্পানি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আবেদন করবে, যা অনুমোদন করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
একটি বিমা কোম্পানির সিইও বলেন, ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার সিইও নিয়োগের আবেদন নামঞ্জুর করার একাধিক কারণ রয়েছে। একদিকে তার পরিবারের একাধিক সদস্য রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক এবং তিনি নিজেও অন্য কোম্পানির পরিচালক। ফলে আইন অনুযায়ী, তিনি বিমা কোম্পানির সিইও হতে পারেন না।
তিনি বলেন, ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার নিয়োগ নামঞ্জুরের ক্ষেত্রে আইডিআরএ আইনের যে ধারা উল্লেখ করেছে সেটাও সঠিক হয়নি। এক্ষেত্রে আইডিআরএ’র কর্মকর্তাদের আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকা একটি কারণ হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আইনের অপব্যাখ্যা করেছে। যেটিই হোক তা সার্বিক বিমা খাতের জন্য ভালো লক্ষণ নয়।
যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ’র মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, রূপালী ইন্স্যুরেন্সের সিইও নিয়োগের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে। প্রয়োজন হলে এরপর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিমা আইনের যে ধারা অনুযায়ী ফৌজিয়ার নিয়োগ নামঞ্জুর করা হয়েছে, সেই ধারা অনুযায়ী তো আইডিআরএ নয়, কোম্পানি পদক্ষেপ নেবে। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আইনের এ বিষয়টি আমার জানা নেই।
তথ্য গোপন করে সিইও হওয়ার চেষ্টার বিষয়ে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজের সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
পরে ফৌজিয়ার বাবা ও রূপালী ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আইডিআরএ আইনের যে ধারা অনুযায়ী ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার সিইও নিয়োগ আবেদন নামঞ্জুর করেছে, সেই ধারা অনুযায়ী তারা এটি পারে না। আমরা আইডিআরএ’র নামঞ্জুর সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছি, এটি আমরা দেখবো।
আপনার মেয়ে রূপালী ইন্স্যুরেন্স এবং অন্য একটি বিমা কোম্পানির পরিচালক, কিন্তু সিইও নিয়োগের আবেদনের সঙ্গে যে জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়া হয়েছে, সেখানে এ তথ্য গোপন করা হয়েছে। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হলে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস বলেন, সে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক না।