হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে বিমানবন্দরসংলগ্ন ২টি বেসরকারি তারকা হোটেল ও ১টি শপিং কমপ্লেক্সসহ ৫টি বহুতল ভবন।
বিমানবন্দরে আসা দেশি-বিদেশি ভিআইপিদের চলাচলে মারাত্মক হুমকি হতে পারে এই স্থাপনাগুলো। ভবনগুলো থেকে বিমানবন্দরের প্রতিটি স্পর্শকাতর স্থান দেখা যায়। বহুতল ৫টি ভবনের ছাদ ব্যবহার করে যে কোনো ধরনের নাশকতা হতে পারে। হতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও।
অভিযোগ উঠেছে, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) কোনো ধরনের নিয়মনীতি অনুসরণ না করেই এ রকম একটি স্পর্শকাতর এলাকায় বেসরকারি মালিকানার ৫টি বহুতল ভবন করার অনুমতি দিয়েছে। সিদ্ধান্তটি বেবিচকের চরম অদূরদর্শী ছিল। ভবনগুলো চালু হলেই আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরটি বড় ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এলাকাজুড়ে তৈরি হবে চরম যানজট। এ অবস্থায় কেপিআই (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) কর্তৃপক্ষ, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), এনএসআই ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া বিমানবন্দরের প্রবেশমুখের ১টি ১২ তলা ৫ তারকা হোটেল, ১টি ১৩ তলা ৩ তারকা হোটেল ও ১টি ৬ তলা শপিং কমপ্লেক্স, ১টি ১২ তলা কার পার্কিং ও অফিস কমপ্লেক্স এবং ১টি ৩ তলা ব্যাংকুয়েট হল যাতে কোনোভাবে চালু করতে না পারে সেজন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ২০ জুলাই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত কেপিআইডিসির সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ ঘটনায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ২ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি শাহজালালের সীমানা প্রাচীর থেকে নির্মিত ভবনগুলোর দূরত্ব নির্ধারণপূর্বক প্রতিবেদন তৈরি করে বেবিচক ও কেপিআইডিসির কাছে পাঠানো হবে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ইপকো কর্তৃক নির্মিত হোটেল ও মার্কেটের ২ শতাংশ মালিকানা সিভিল এভিয়েশনের। যেহেতু কেপিআই কর্তৃপক্ষের এই প্রতিষ্ঠানগুলো চালুর ব্যাপারে আপত্তি আছে তাই সব সংস্থা সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরই বহুতল ভবনগুলো চালুর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষও সোমবার এক জরুরি সভায় কেপিআইডিসির এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানা গেছে দেশের দুটি শীর্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিট ও ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানাধীন এই ভবনগুলো নিয়ে এখন বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়েছে সরকার। ভবন নির্মাণের অনুমতি ও লিজ ছাড়পত্র দিয়েও বেকায়দায় আছে বেবিচক। ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হয়ে গেছে ২০২১ সালে। কিন্তু নানা বাধ্যবাধকতার কারণে এক বছর ধরে ভবনগুলো চালু করতে পারছে না। এ অবস্থায় বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার বিশাল এই প্রকল্পটি। কেপিআই কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, বহুতল ভবনগুলো চালু হলে বিমানবন্দর এলাকায় চরম যানজটের সৃষ্টি হতে পারে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন কেপিআইডিসির সভাপতি ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আশরাফ হোসেন। এ সময় কেপিআইডিসির আরও ১৩ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভায় বলা হয়, সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি ইপকো, সামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানাধীন ৫টি বহুতল ভবনের কারণে বড় ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়তে পারে কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
সভায় এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া কোনো ধরনের নিয়মনীতি অনুসরণ না করে অবৈধভাবে কেপিআই স্থাপনার মধ্যে এ ধরনের হোটেল ও মার্কেট নির্মাণের জন্য ভূমির বন্দোবস্ত দেওয়ার সিদ্ধান্তকে চরম অদূরদর্শিতা বলেও মন্তব্য করা হয়।
জানা গেছে, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সঙ্গে বিওটি ও ল্যান্ড লেসি চুক্তির আওতায় বাস্তবায়নাধীন ইপকো হোটেল প্রকল্পের জন্য আবেদন করেন ইপকো ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড।
সভার কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, কেপিআই জরিপ কমিটি ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন পাঠায়। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ১ ‘ক’ শ্রেণির কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান। ১২৯৮ একর জমির ওপর বিমানবন্দরের অবস্থান।
আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে যাত্রী ও মালামাল পরিবহণে বিমানবন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিনিয়ত এই রুটে দেশি-বিদেশি যাত্রী আসা-যাওয়া এবং পণ্যবাহী বিমান ওঠানামা করে। কেপিআইর অভ্যন্তরে কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে কেপিআইডিসির অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক।
কেপিআইডিসির অনুমোদন ছাড়া বেবিচক সিঙ্গাপুরের সংস্থা ইপকো ডেভেলপমেন্টকে ২০০০ সালে ৬০ বছরের জন্য ১৫ দশমিক ৭৪ একর জমি লিজ দেয়। শুরুতে ইপকো ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও বেঙ্গল গ্রুপ যৌথভাবে ২০০০ সালেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে ইপকো হোটেলস ও শপিং কমপ্লেক্সের নামে নকশা অনুমোদন করে। তারা বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে একটি ১২ তলাবিশিষ্ট পাঁচ তারকা হোটেল, একটি ১৩ তলাবিশিষ্ট তিন তারকা হোটেল, একটি ৬ তলা শপিং কমপ্লেক্স, একটি ১২ তলা কার পার্কিং ও অফিস কমপ্লেক্স এবং একটি তিনতলা ব্যাংকুয়েট হলের নির্মাণকাজ শুরু করে। ভবনগুলোর কাজ অর্ধেক সম্পন্ন হওয়ার পর অজ্ঞাত কারণে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়। এরপর প্রকল্পটির মালিকানায় যোগ হয় সামিট ও ইউনাইটেড গ্রুপ। ২০১১ সালে ইপকো, সামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড গ্রুপ যৌথভাবে পুনরায় ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শুরু করে। এতে ব্যয় হয় ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ। ২০২১ সালে ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হয়।
বেবিচকের একটি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর বেবিচকের জরিপ কর্তৃপক্ষ কেপিআইডিসির কাছ থেকে ভবন নির্মাণের অনুমতি ও নিরাপত্তার বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি নেই কোনো সংস্থার কাছে। এমনকি চুক্তির বিষয়টি কেপিআইডিসির সভাপতি ও জরিপ কমিটির সভাপতিকে অবহিত পর্যন্ত করা হয়নি।
কেপিআইডিসির সভায় বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে বেবিচকের সঙ্গে সমন্বয় করে জরুরি ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে কেপিআইডিসির কাছে পাঠাতে বলা হয়। এছাড়া কেপিআই জরিপ কমিটির প্রতিবেদনে বর্ণিত যেসব নিরাপত্তাঝুঁকির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, সেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বেবিচক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকার পুলিশ কমিশনারকে এ বিষয়ে অনুরোধ করা হয়। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীর থেকে নির্মাণাধীন ভবনগুলোর দূরত্ব নির্ধারণ করে কেপিআইডিসির কাছে প্রতিবেদন পাঠাতে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়।
এর আগেও কেপিআইর একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ঘাটতি, ফ্লাডলাইট ও দুর্বল সিসিটিভি ক্যামেরার কারণে এলাকাটি নিরাপত্তাঝুঁকিতে আছে। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে এই জরিপ চালানো হয়।
ওই বছরের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে ওই জরিপের প্রতিবেদন জমা দেন তারা। ওই প্রতিবেদনেও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে আছে বলে জরিপ দলটি জানিয়েছিল। প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এখন বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে। কাজের প্রায় ৩০ শতাংশ শেষ।
ওই প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল, বিমানবন্দরের খুব কাছেই অনেক উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণেও এর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। বিমানবন্দরে প্রবেশকারী যানবাহন নিচ থেকে স্ক্যান করার জন্য চারটি গেটে ক্যামেরা বসানোর জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে।