আকস্মিকভাবেই গত মাসে ‘শ্রম অধিকার লঙ্ঘনকারীদের’ বিরুদ্ধে ট্রেড পেনাল্টি বা বাণিজ্যে জরিমানা, ভিসা বিধিনিষেধসহ শাস্তিমূলক পদক্ষেপের নির্দেশনা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ সংক্রান্ত ‘মেমোরেন্ডাম অন অ্যাডভান্সিং ওয়ার্কার এমপাওয়ারমেন্ট, রাইটস অ্যান্ড হাই লেবার স্ট্যান্ডার্ডস গ্লোবালি’ স্মারকে সই করেন। এ ঘোষণায় বেশ আতঙ্ক তৈরি হয় দেশের পোশাকখাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র আসলে নিষেধাজ্ঞা, না জরিমানার কথা বলেছে তা নিয়েও তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
যুক্তরাষ্ট্রের জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়, বিশ্বজুড়ে যারা শ্রমিক অধিকার হরণ করবে, শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখাবে এবং আক্রমণ করবে তাদের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও চাইলে দেশটি বিধিনিষেধসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে।
আমেরিকার নির্দেশনায় স্যাংশন্স না আলোচনা হলেও সেখানে ট্রেড পেনাল্টি বা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। তারা তো বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কথা বলেনি, জরিমানার কথা বলেছে। তাহলে ভয় না করে ম্যানেজ করতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের দেখতে হবে বিষয়টা কোনদিকে যায়। ইপিজেডগুলোয় ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন আছে, সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন করতে হবে।- শ্রম-বাণিজ্য বিশ্লেষক মোস্তফা আবিদ খান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া এটি ট্রেড পেনাল্টি (বাণিজ্যে জরিমানা) না ট্রেড স্যাংশন্স (বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা) তা নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। শ্রমিক নেতারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতিকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। ব্যবসা ধরে রাখতে হলে তাদের মেমোরেন্ডাম (স্মারকপত্র) বিবেচনায় নিতে হবে। সব ছাপিয়ে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা যদি দেওয়াই হয়, সেটাকে কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলাই একমাত্র পথ হিসেবে দেখছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১৬ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করার প্রত্যয়ে একটি মেমোরেন্ডামে সই করেন। দেশটি জানায়, শ্রমিকদের অধিকার ও তাদের শ্রমমান উন্নয়নের জন্য কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির কেন্দ্রীয় অংশ। এটি পররাষ্ট্র দপ্তরেরও কার্যক্রমের মূল বিষয়। দেশটি এর মাধ্যমে বার্তা দেয়, ‘শ্রমিকদের হুমকি দেবে, ভয় দেখাবে, শ্রম ইউনিয়নের নেতা, শ্রম অধিকারের পক্ষে কাজ করা ব্যক্তি এবং শ্রম সংগঠনের ওপর আক্রমণ করবে এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, না জরিমানা?
এ বার্তায় নড়েচড়ে বসেন দেশের পোশাকখাত সংশ্লিষ্টরা। কারণ রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ নেতৃত্ব দেওয়া এ খাতটিতে সম্প্রতি মজুরি নিয়ে দেখা দেয় শ্রমিক অসন্তোষ। এতে প্রাণ হারিয়েছেন চারজন শ্রমিক। আহত শতাধিক, মামলা হয়েছে একাধিক। যেখানে শ্রমিক নেতা ও সাধারণ শ্রমিকরা আসামি। যদিও নিরপরাধ কাউকে হয়রানি না করার কথা উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে। তবুও শঙ্কা-সংশয়, রয়েছে আশাবাদও। কারণ শ্রম অধিকারের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপই গেছে শ্রমিকদের পক্ষে। যদিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখার কথা বলছেন শ্রমিক নেতারা।
এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা তৌহিদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবশ্যই আমেরিকার শ্রমনীতিকে বিবেচনায় নিতে হবে। দেশের ব্যবসা ধরে রাখতে হলে তাদের মেমোরেন্ডাম বিবেচনায় নিতে হবে। মনে হচ্ছে পশ্চিম আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক আন্দোলনে চারজন শ্রমিকের মৃত্যু হলো। এ হত্যাকাণ্ডের কেন তদন্ত হচ্ছে না, বিচার হচ্ছে না, কেন? আগামীর পথচলা মসৃণ করতে হলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।’
শ্রম ইস্যুতে আমেরিকা ট্রেড স্যাংশন্স (বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা) দিতে পারবে না বলছেন পোশাক মালিকরা। এ বিষয়ে নিটওয়্যার উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শ্রম ইস্যুতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আইএলও কনভেশনে ট্রেড ইউনিয়নে ১৯৭৪ সালে সই করেছে বাংলাদেশ। আইএলও কনভেশন ৯৮-এ আমেরিকা এখনো সই করেনি। শ্রমিকদের অধিকার প্রশ্নে কোর বা ফান্ডামেন্টাল কনভেনশনালে আটটির মধ্যে মাত্র দুটোতে আমেরিকা সই করেছে, বাংলাদেশ সই করেছে সবগুলোতেই। সম্প্রতি ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হয়েছে শ্রমিকদের জন্য, সেখানে ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে শ্রম ইস্যুতে তারা কোনোভাবেই নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে না।’
আমেরিকার নেওয়া ‘মেমোরেন্ডাম অন অ্যাডভান্সিং ওয়ার্কার এমপাওয়ারমেন্ট, রাইটস অ্যান্ড হাই লেবার স্ট্যান্ডার্ডস গ্লোবালি’ নির্দেশনায় কোন স্যাংশন্সের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
শ্রম-বাণিজ্য বিশ্লেষক মোস্তফা আবিদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমেরিকার নির্দেশনায় স্যাংশন্স না আলোচনা হলেও সেখানে ট্রেড পেনাল্টি বা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। তারা তো বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কথা বলেনি, জরিমানার কথা বলেছে। তাহলে ভয় না করে ম্যানেজ করতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের দেখতে হবে বিষয়টা কোনদিকে যায়। ইপিজেডগুলোয় ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন আছে, সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন করতে হবে।’
লোহিত সাগরে পণ্য পরিবহনে বাধাগ্রস্ত হলে দেশের রপ্তানিও কিছুটা সমস্যা তৈরি হবে। রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময় (লিড টাইম) বেড়ে যাবে প্রায় অতিরিক্ত দুই সপ্তাহ। এতে খরচ বাড়বে, রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।- বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান
চাইলেই কি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে আমেরিকা-ইউরোপ? নিষেধাজ্ঞা দিলে এর সমাধান কোন পথে? শঙ্কা ও সমাধান নিয়ে উদ্যোক্তা এবং ফতুল্লা অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘আমেরিকা চাইলে বাণিজ্যে জরিমানা করতে পারবে। তবে ইউরোপ চাইলে এখনই পদক্ষেপ নিতে পারবে না, তাদের পার্লামেন্টে পাস হতে হবে, যা করতে আড়াই মাসের বেশি সময় লাগবে। যেখানে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো কোনো কিছু বাংলাদেশ থেকে করা হয়নি। তবে আমেরিকা এরপরও যদি স্যাংশন্স দেয় তবে সেটা হবে রাজনৈতিক। যেটার একমাত্র পথই হলো কূটনৈতিকভাবে সমাধান। সরকারকে এ পদক্ষেপ নিতে হবে, উদ্যোক্তারা সহযোগিতা করবে।’
পোশাকশিল্পে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে লোহিত সাগরের অস্থিরতা নিয়ে। হুতি বিদ্রোহীদের কারণে এরই মধ্যে বড় বড় কার্গো জাহাজ চলাচল করছে না। আর বিকল্প রুটে পণ্য পরিবহনে সময় লাগবে বেশি, ব্যয়ও বেড়ে যাবে। এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘লোহিত সাগরে পণ্য পরিবহনে বাধাগ্রস্ত হলে দেশের রপ্তানিতেও কিছুটা সমস্যায় তৈরি হবে। রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময় (লিড টাইম) বেড়ে যাবে প্রায় অতিরিক্ত দুই সপ্তাহ। এতে খরচ বাড়বে, রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’