কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

মতবিনিময়কালে প্রয়োজনী সংস্কার করে ‘যৌক্তিক’ সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।

শনিবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় বিকাল ৩টা থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিরিজ মতবিনিময় সভায় এই দাবি উঠে বলে সভা শেষে বিভিন্ন দলের নেতারা গণমাধ্যমের কাছে এ কথা জানান।

বিকাল ৩টায় ৬টি ইসলামী দলের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সিরিজ মতবিনিময় সভা। ছয়টি ইসলামী দল হচ্ছে খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, খেলাফত আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম, জমিয়তে উলামে ইসলামী এবং নেজামী ইসলাম। এরপর উপদেষ্টা বৈঠক করেন চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করীমের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ এর সঙ্গে।

এরপর অলি আহমদের নেতৃত্বে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে ১২ দলীয় জোট এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক হয় প্রধান উপদেষ্টার। এসব বৈঠকে প্রত্যেকটি দল তাদের দলীয় প্যাডে নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রস্তাবনা ও দাবি লিখিতভাবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করেন।

রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান ও ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা এএফএম খালিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল অলি আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যস্ত রাখার জন্য একমাত্র অস্ত্র হলো একটা ফোরকাস্ট দিয়ে দেওয়া। এটা ছয় মাস পরেও হতে পারে, নয় মাস পরেও হতে পারে। সংস্কার করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার কথা আমরা বলেছি। কিন্তু নির্বাচন তো হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্যও ভালো, রাজনৈতিক দলের জন্যও ভালো, দেশের জন্যও ভালো। তবে সংস্কার করার পূর্বে কোনো নির্বাচন কোনো অবস্থাতে বাঞ্ছনীয় নয়। সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। দেশের মধ্যে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।’

নির্বাচনের বিষয়ে আপনাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা কি বলেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা এটাই বলেছেন যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে প্রত্যেকটা বিষয়ে। আমি উত্তর দিকে গেলাম, আপনি দক্ষিণ দিকে গেলেন তা হলে তো দেশের সমস্যার সমাধান হবে না। সবাইকে একটা ঐকমত্যে আসতে হবে।’

৮৩ দফা প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টাকে দিয়েছেন বলে জানান এলডিপি প্রধান। দেশে গণহত্যার জন্য আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের প্রসঙ্গ টেনে অলি বলেন, ‘জামায়াতকে যদি ছোট ছোট তুচ্ছ কারণের জন্য তাদের নিবন্ধন বাতিল করা যায় আমাদের হাজার ছেলেমেয়েদের হত্যা করার জন্য, ১৫ বছর কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গুম করার জন্য তাদের (আওয়ামী লীগ) বাতিল হবে না। এটা বাতিল করা অত্যন্ত প্রয়োজন। না হলে আগামীতে স্বৈরাচারের জন্ম বাংলাদেশে হবে। আমি এই সরকারের পতনের আগেই সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলাম এই সরকার পালানোর সুযোগ পাবে না।

২০২৪ সাল হচ্ছে নতুন নতুন ঘটনা ঘটবে- তাই ঘটেছে। আরও ঘটতে পারে। আমি আজকে বৈঠকে সাবধান করে দিয়েছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলেছি, আপনি এখনো বিপদমুক্ত নন। এখনো যারা ষড়যন্ত্রকারী তারা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। যারা হাসিনার পদলেহি ছিল তারা এখনো চাকরিচ্যুত হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়নি তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদলি করলে সমস্যার সমাধান হবে না। তারা দেশের শত্রু, তাদের জেলে নিতে হবে।’

ছয় ইসলামী দলের সঙ্গে প্রথম মতবিনিময় সভাটি শেষে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার আমাদের ফলোপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আমরা উনাকে বলেছি যে, তিনি একটি যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে অযথা যেন কালবিলম্ব না করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন যে, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর তারা কালবিলম্ব না করে নির্বাচনে যেতেই আগ্রহী এবং সেই ধরনের তারা প্রস্ততি এবং আয়োজন করছেন।’

যৌক্তিক সময়টা কতদিন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘যৌক্তিক সময়টি কত দিনের এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আমাদের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি, আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নিয়ে আলোচনা করিনি।’

বৈঠকে ইসলামী দলগুলোকে দুর্গাপূজা উপলক্ষে মন্দির, পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃবৃন্দের কাছে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটে। ইসলামী দলগুলোর নেতারা বৈঠকের পর বিষয়টি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের কাছেও তুলে ধরেন।

চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, ‘আমাদের মূলত আলোচনাগুলো ছিল বিগত এই ফ্যাসিস্ট সরকার প্রায় ১৬ বছর পর্যন্ত তাদের মনগড়া দলীয়করণ এবং ২০১৪, ’১৮ এবং ’২৪ এর যে প্রহসনমূলক জাতীয় নির্বাচন এবং এই নির্বাচনগুলো উঠিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে যারা নাকি প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করেছেন, যারা নাকি বিভিন্ন মিডিয়াসহ সর্বত্র ওই সরকারকে সহযোগিতা করেছে সেটা অন্যায়, তাদের অন্যায় চিহ্নিত করে একটা নির্ভরযোগ্য প্রশ্নবিদ্ধ ছাড়া একটা কমিশন গঠনের মাধ্যমে এই অন্যায়কারীদের চিহ্নিত করে তাদের ব্যবস্থা করার বিষয়টি আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলছি। সুন্দরভাবে যোগ্যদের দিয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে আমরা পরামর্শ দিয়েছি। বলেছি, এই সব জায়গাগুলোতে একটা স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন দেওয়া হলে তখন আবার আগের সেই পরিবেশের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। সেজন্য আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, পরিবেশ তৈরি করতে হবে আগে।’

চরমোনাইয়ের পীর বলেন, ‘আমাদের ৫৩ বছরের বাংলাদেশে যে নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে সেখানে কালোটাকার দৌরাত্ম্য এবং দলীয়করণ হয়। পেশিশক্তির মাধ্যমে আসলে মূলত যারা নাকি যোগ্য যাদের দেশের প্রতি প্রেম রয়েছে এই ধরনের ব্যক্তিরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায় না। সেজন্য আমরা পিআর সিস্টেম যেটা সব শাখার সব পেশা, সব ধারার মনমানসিকতার এখানে সম্পৃক্ত হবে। সংখ্যানুপাত হারে নির্বাচনটা হতে হবে।

সেখানে দল ও প্রতীক থাকবে- জনগণ ভোট দেবে এবং সেখানে যে যেই দল যেভাবে ভোট পাবে সেই অনুযায়ী তাদের প্রতিনিধি পার্লামেন্টে থাকবেন। ফলে সব পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হবে, আর কোনো বৈষম্যমূলক বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। আমরা এই বিষয়গুলো আমাদের প্রস্তাবনায় তুলে ধরেছি।’

ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে গ্রহণযোগ্য্য তদন্ত কমিশন, স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই গণহত্যার বিচার, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে ব্যক্তি ও সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করাসহ ১৩ দফা দাবি প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়া হয়।

খেলাফত মজলিশের মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদ আবদুল কাদের বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা যেসব চুক্তি করেছেন সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে যেগুলো দেশবিরোধী চুক্তি সেগুলো বাতিল করার কথা আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি। একই সঙ্গে আলেম সমাজ, হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীসহ বিরোধী দলগুলোর যে মামলা শেখ হাসিনার সরকার দিয়েছে সেগুলো আগামী এক মাসের মধ্যে প্রত্যাহারের একটা টাইমফ্রেমের কথা আমরা বলেছি।’

খেলাফত মজলিশের পক্ষ থেকে আশু সংস্কারের ৭ দফা প্রস্তাবও দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে সরকার ব্যবস্থা কাঠামোগত সংস্কার, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদের বেশি না থাকা এবং কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় প্রধান পদে না থাকা, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার, প্রশাসনিক, আর্থিক শিক্ষা ব্যবস্থা, কালাকানুনসহ আইনি সংস্কারের প্রস্তাব করেছে ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে খেলাফত মজলিশ।

সংবিধানে যে আল্লাহর ওপরে অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের যে ধারাটি ছিল সেটা বাতিল করেছে সেটা আবার যেন পুনর্বহাল করা হয়। সংবিধানে এজন্য সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছি। দেশে নীতিমালা ও আইনপ্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলাম বিরোধী নীতি বা আইন যেন না হয় সে বিষয়ে আমরা দাবি জানিয়েছি প্রধান উপদেষ্টার কাছে।’ তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন আন্দোলনে ২০১৩, ২০১৬ ও ২০২১ সালের বহু মামলা ও হতাহত রয়েছে। তাদের অনেকের সন্ধানও আমাদের কাছে নেই। আমরা সেই ব্যাপারেও সহযোগিতা চেয়েছি যেন আমাদের সব শহীদ ও নিখোঁজ মানুষকে নিয়ে একটি সুন্দর প্রতিবেদন আমাদের কাছে আসতে পারে। সব হত্যাকাণ্ডের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার প্রস্তাবও আমরা বলেছি।
প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে এই সরকারকে স্বাগত জানানো হলেও গত ২৪ আগস্ট থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন প্রশ্নে ‘অতি দ্রুত’ সংলাপের দাবি জানাচ্ছিলেন। এর দুই দিন পর এই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এই সিরিজ মতবিনিময় সভা হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘অতি দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে প্রধান উপদেষ্টা মতবিনিময় করবেন।