বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোর উন্নয়নে বাড়ছে যানবাহনের গতি। সড়কে বাড়ছে বিশৃঙ্খলাও। প্রতিনিয়তই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। ঈদ বা বড় কোনো উৎসবের ছুটিতে আনন্দ রূপ নিচ্ছে বিষাদে। একেকটি দুর্ঘটনা প্রাণ কাড়ছে বহু মানুষের। নিঃস্ব হচ্ছে পরিবার।

সড়কের এসব দুর্ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে সড়ক-মহাসড়কগুলোতে বিশৃঙ্খলা, আইনের প্রয়োগ যথাযথ না হওয়া এবং তদারকি সংস্থার গাফিলতিকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ড. মো. শামসুল হক। তিনি ঢাকার মেট্রোরেল, হাতিরঝিল প্রকল্পসহ উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক এবং কুড়িল ইন্টারচেঞ্জের পরিকল্পনাকারী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মো. নাহিদ হাসান।

ড. মো. শামসুল হক বলেন, সড়কের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গতি ও বিশৃঙ্খলা দুটোই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, এজন্য দুর্ঘটনাও বাড়ছে। দুর্ঘটনা ঘটে বিশৃঙ্খলা থেকে। দুর্ঘটনা ঘটার জন্য যে উপকরণগুলো দরকার সেগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি, শুধু উন্নয়ন দিয়ে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এটা পরিকল্পনা ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যদি সুশৃঙ্খল করতে পারতাম তাহলে সড়কে বিশৃঙ্খলা থাকতো না। খুব সহজেই দুর্ঘটনা কমে যেত এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো।

এবারের ঈদযাত্রায় আইন প্রয়োগে কঠোরতা না দেখানোয় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, আমি মূল কারণ বলবো আইন প্রয়োগে অত্যন্ত ঢিলেঢালা থাকা। এবং সারা বছরের জমানো কাজগুলো জনবল দিয়ে ঈদের সময় করতে চাওয়া। বাইরের অনেক দেশে ১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে গাড়ি চালানো হয় কিন্তু সেখানে দুর্ঘটনা ঘটে না। কারণ সেসব দেশে সুশৃঙ্খলভাবে উচ্চগতির গাড়িগুলো এক জায়গায় থাকে, আবার ধীরগতির গাড়িগুলো আরেক জায়গায় থাকে। গাড়ি চলাচলের সময় গতির কোনো তারতম্য হয় না।

‘সড়কের অসঙ্গতিপূর্ণ কোনো ব্যবহার হয় না। আনফিট গাড়ি ও আনফিট ড্রাইভার সড়কে ঢুকতেই পারে না। আমাদের দেশে যখনই দুর্ঘটনা ঘটে তখনই দেখা যায় গাড়ির ফিটনেস নেই, চালকের যোগ্যতা নেই। স্বাভাবিকভাবে মনে হয় আনফিট গাড়ি এবং চালক সড়ক-মহাসড়কগুলোতে মহামারির মতো বিদ্যমান। এজন্য দুর্ঘটনা কম হওয়াটাই অস্বাভাবিক, দুর্ঘটনা বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক।’

সড়কে শৃঙ্খলা একদিনে তৈরি করা সম্ভব নয়, বছরের পর বছর নজর দিয়ে শাসন করে তৈরি করতে হয়। তাহলে উপকারটা উৎসবের সময় পাবো, দুর্ঘটনা কম হবে যানজট কম হবে।

এই পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমি যদি সারা বছরের কাজ ম্যারাথনিস্টভাবে করি, ঈদযাত্রায় এত মানুষ নামাতে হয় না। ঈদযাত্রায় সড়ক সুশৃঙ্খল করার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসন, আনসার, স্কাউট সদস্যদের রাস্তায় নামাতে হয়। সড়কে শৃঙ্খলা একদিনে তৈরি করা সম্ভব নয়, বছরের পর বছর নজর দিয়ে শাসন করে তৈরি করতে হয়। তাহলে উপকারটা উৎসবের সময় পাবো, দুর্ঘটনা কম হবে যানজট কম হবে। তাহলে আমরা সারা বছরই উচ্চ অর্থনীতিবান্ধব সড়ক পাবো।

সড়ক যেন মৃত্যুপুরী, উৎসব রূপ নিচ্ছে বিষাদে
ফরিদপুর-ঝালকাঠির দুর্ঘটনায় অতিরিক্ত গতি-সড়ক অবকাঠামো দায়ী
ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের একি হাল!
বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের মধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশ সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে এনেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বের আরও অনেক দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ছিল, তারা বিজ্ঞানের কাছাকাছি গেছে, সড়ক সুশৃঙ্খল করেছে। এজন্য তারা সড়ক দুর্ঘটনাও কমিয়ে আনতে পেরেছে। আমাদের দেশের সড়কগুলো সুশৃঙ্খল করতে শুধু আইন প্রয়োগ করলে হবে না। যেমন, সড়কে এত বাস এদের সড়কে নামিয়ে আইন প্রয়োগ করে সুশৃঙ্খল করার চেয়ে বাসগুলো নামানোর আগেই বলি যে কোম্পানিভিত্তিক নামবে। একটি রুটে যদি নির্দিষ্ট একটি বা দুটি কোম্পানির বাস দেওয়া হয় তাহলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকবে না আর দুর্ঘটনার হারও কমে আসবে।

‘হাতিরঝিলে মাত্র একটি কোম্পানির বাস চলাচল করে। গুলশানে দুটি কোম্পানির গাড়ি চলে। ক্যান্টনমেন্টের মধ্যেও দুই বা তিনটি কোম্পানির গাড়ি চলাচল করে। এসব জায়গায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা নেই। তারা সড়ক পরিচ্ছন্ন রাখে, রাস্তায় যেন পথচারীর চাপ না থাকে সেজন্য ফুটপাত ব্যবহার করা হয়। এটা সারা বছর ধরে তারা নজরদারি করে। পরিকল্পনা হতে হবে স্মার্ট এবং স্বনিয়ন্ত্রিত।’

বিআরটিএর সমালোচনা করে এই অধ্যাপক বলেন, এখন যারা বাসের রুট পারমিট দেয়, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের অনুমতি দেয় দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এরা না জানা লোক। বিজ্ঞানের ধারে কাছেও এদের জ্ঞান নেই। এসব জায়গায় যদি বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান না করা যায় তাহলে সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশ, মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং জেলা পুলিশ নিজেদের ক্ষেত্রে এমন কোনো ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারেনি যে তাদের দেখলে মনে হবে আমি আইন মানবো।

একমাত্র অবকাঠামোর উন্নয়ন করে সরকার যদি ভাবে দুর্ঘটনা কমিয়ে ফেলবে, পরিসংখ্যান বলছে এরকম ভাবার কোনো সুযোগ নেই। দ্রুতগতির সড়কে যদি ধীরগতির যানবাহন চলাচল করে তাহলে যে গতির বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় এতে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ে।

সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন করে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, একমাত্র অবকাঠামোর উন্নয়ন করে সরকার যদি ভাবে দুর্ঘটনা কমিয়ে ফেলবে, পরিসংখ্যান বলছে এরকমটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। দ্রুতগতির সড়কে যদি ধীরগতির যানবাহন চলাচল করে তাহলে যে গতির বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় এতে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ে।

‘আমরা অনেক সময় দেখি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গেছে বা ট্রাক উল্টে গেছে। এর মূল কারণ দ্রুতগতির সড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল। অনুসন্ধান করলে দেখা যায় সামনে কোনো ইজিবাইক বা সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে বাঁচাতে গিয়ে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বহু লোকের প্রাণ গেছে।’

সড়কের উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ছে উল্লেখ করে ড. মো. শামসুল হক বলেন, জনগণের টাকায় সড়ক নির্মাণ করে জনগণের নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত হয় সেটি সরকারকে দেখতে হবে। সরকারের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে, কারণ সরকার ধারাবাহিক এবং একই সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ১৪ বছর ধরে দায়িত্বে। সড়কের উন্নয়নটা বড় কথা নয়, সড়ক সংস্কার করার জন্য যে সময় লাগে সে সময় সরকার পেয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত দায়টা বর্তায় সরকারের ওপরই।

উন্নয়ন মানে দ্রুতগতি নয়, উন্নয়ন হলো নিরাপদে পৌঁছানো। এখন দায়িত্ব পালনে কেউ যদি গাফিলতি করে পার্লামেন্টে স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে, সরকারের মন্ত্রী আছেন তাদের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুধু উন্নয়ন করে চোখ ধাঁধালেই হবে না, উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে কি না নিরাপদ হচ্ছে কি না সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’

‘সরকারের অঙ্গ সংগঠন যেগুলো আছে তাদের দিয়ে যে কাজটা আদায় করার কথা সেটি আদায় হচ্ছে না। এগুলো সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। কারণ উন্নয়ন মানে দ্রুতগতি নয়, উন্নয়ন হলো নিরাপদে পৌঁছানো। এখন দায়িত্ব পালনে কেউ যদি গাফিলতি করে পার্লামেন্টে স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে, সরকারের মন্ত্রী আছেন তাদের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুধু উন্নয়ন করে চোখ ধাঁধালেই হবে না, উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে কি না নিরাপদ হচ্ছে কি না সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’

সরকারের অধীনে যেসব সংস্থার সড়ক মনিটরিং করার কথা তারা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব সংস্থার এসব বিষয় নিশ্চিত করার কথা তারা ধারাবাহিকভাবে গাফিলতি করছে। ২০১৮ সাল থেকে মহাসড়কে সিএনজি, থ্রি-হুইলার নিষিদ্ধ। তাহলে সেগুলো কীভাবে সড়কে চলাচল করছে। এর উত্তর সরকারকে পেতে হবে। সরকার যদি সে উত্তর না পায় তাহলে বুঝতে হবে এই উন্নয়নগুলো কারও কারও বেনিফিটের জন্য হচ্ছে, জনগণের জন্য নয়।

বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সড়ক অবকাঠামোর ত্রুটি দায়ী উল্লেখ করে ড. মো. শামসুল হক বলেন, সড়কের অবকাঠামো উন্নয়ন যারা করেন তারা নিরাপত্তা সমন্বিত করেন না। সড়কের অবকাঠামো নির্মাণের আগে নিরাপত্তার বিষয়টি যথেষ্ট ভালোভাবে বিবেচনায় নিতে হয়। নির্মাণের ত্রুটির জন্য, রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটির জন্য, অপারেশন কার্যক্রম যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারি সেজন্য দুর্ঘটনা ঘটে। যারা ওভারলোডের গাড়ি চালাচ্ছে, ট্রাকের মধ্যে যাত্রী নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে- এগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে অন্যায় হচ্ছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, বিজ্ঞানভিত্তিক নিরাময় ব্যবস্থা দরকার। কারণ দুর্ঘটনা কখনো একটি কারণে ঘটে না। এর সঙ্গে পারিপার্শ্বিক অনেক বিষয় জড়িত থাকে। এখানে সংশ্লিষ্ট যারা আছে, প্রত্যেকেরই দুর্ঘটনার পেছনে কিছু না কিছু দায় আছে। এ দায়গুলো নির্ধারণ করতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক।

দুর্ঘটনার পেছনে চালকদের দায়ভার ছাড়া অন্য কারণগুলো দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বিআরটিএকে একটি রেগুলেটরি অথরিটি হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। তারা যেমন লাইসেন্স দেবে এবং সেটি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না তারও তদারকি করবে। সব বিভাগের সমন্বিত ও পরিকল্পিত কার্যক্রম সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পারবে। না হলে শুধু সড়কের উন্নয়ন হবে, পাশাপাশি দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়তে থাকবে।