ঢাকার বিজয়নগরে রাস্তার পাশের ফুটপাতে লুঙ্গি বিক্রি করছিলেন সুকান্ত ঘোষ। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী। সেখানে তার পারিবারিক তাঁত রয়েছে। লুঙ্গিগুলো সেখানেই তৈরি। জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রাখতে মোকাম ছেড়ে পরিবারের দুই সদস্যসহ ঢাকায় ফেরি করে লুঙ্গি বিক্রি করেন। তাতেও হরতাল-অবরোধের ধাক্কা।

সুকান্ত জাগো নিউজকে জানান, যখন কুমারখালীর মোকামে একদমই বেচাকেনা থাকে না তখন ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে ফেরি করে লুঙ্গি বিক্রি করেন। চলমান হরতাল-অবরোধে তাদের গ্রাম-গঞ্জের মোকামে একদমই ক্রেতা নেই। বাধ্য হয়ে উৎপাদিত পণ্য ফেরি করতে হচ্ছে।

সুকান্ত বলেন, ‘গাড়িঘোড়া চলে না। মোকামে লোক নেই। সেজন্য শহরে ফেরি করতে এসেছি। এখানেও মাল বিক্রি হচ্ছে না। শহরের রাস্তা-ঘাট ফাঁকা। বিক্রি না হলে খাবো কী? ওদিকে তাঁতের সুতা কেনারও টাকা জুটছে না। তাঁত বন্ধ। এভাবে চললে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে একদিন।

হরতাল-অবরোধে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্তরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। করোনার পরে কিছুটা আমরা কাটিয়ে উঠছিলাম, তাতে এ পরিস্থিতিতে আমরা আবারও মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছি। বারবার ধাক্কা খাচ্ছি।- নাসিব সভাপতি মির্জা নুরুল গনী

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ববাজারে বিভিন্ন শিল্পের প্রাথমিক কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। এতে পণ্যের দাম বেড়ে কমেছে বিক্রি। এরপর দেশেও ডলার সংকট প্রকট হতে থাকে। যার একটি বড় প্রভাব পড়েছে সার্বিক অর্থনীতিতে। সবমিলিয়ে দীর্ঘসময় ধরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে চলমান এ হরতাল-অবরোধ সংকটে ফেলেছে সুকান্তের মতো অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। ভালো নেই মাঝারি উদ্যোক্তারাও।

তারা বলছেন, চলমান অবরোধ-হরতালে দেশের সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি বেশ নাজুক। পুঁজি সংকট ও ভঙ্গুর আর্থিক পরিস্থিতির কারণে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা আছেন বেশি বিপাকে। কিছু কারখানার উৎপাদনও বন্ধ হয়ে গেছে।

অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা একটি প্রতিষ্ঠান আনটাচ-এর কর্ণধার ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেকে এ হরতাল-অবরোধে কাজ হারিয়েছেন। মানুষের হাতে টাকা নেই, খরচ কমিয়েছে। ফলে অনেক অর্ডার বাতিল করা হচ্ছে। এখন খরচ চালানো নিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ছয়-সাতজন কর্মীকে কাজ না থাকলেও দিতে হচ্ছে বেতন।’

এ অবস্থা যে সার্বিক অর্থনীতির জন্য দারুণ ক্ষতিকর সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এ পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুগছে। তাদের পুঁজি কম।- এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান

রামপুরা এলাকায় বেশকিছু শ্রমিক নিয়ে স্টিলের আসবাব ও ঘর সাজানোর নানা পণ্য তৈরির কাজ করেন এসবি স্টিলের কর্ণধার সারোয়ার হোসেন। প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশ থেকে অর্ডার নেয় ও পণ্য সরবরাহ করে। যদিও এখন অবরোধের কারণে কোনো নতুন অর্ডার পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি।

সারোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে স্টিলের কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৩৫-৪০ শতাংশ। এর মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বেড়েছে। এতে গত এক বছরে আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে দেড়গুণ। তাতে এমনিতেই বিক্রি কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছে হরতাল-অবরোধ। ফলে এখন কোনো কাজ পাচ্ছি না।’

তিনি বলেন, ‘অবরোধে বিক্রি ৫০ শতাংশ কমেছে। উৎপাদনও কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। দ্রুত এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি ছোট পরিসরে নিতে হবে।’

 

করোনা মহামারির পর সরকার নানামুখী সুবিধা ও প্রণোদনা দিলেও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরতে পারেননি দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। বরাদ্দ থাকলেও ঋণ পেতে জটিলতা, ডলার সংকটে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি নিয়ে সমস্যা। এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির কারণেও বেড়ে গেছে উৎপাদিত পণ্যের ব্যয়। কিন্তু সে অনুযায়ী পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। যেখানে নতুন করে ভোগাচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ তথ্যমতে, দেশে কুটির শিল্পসহ প্রায় ৭৮ লাখ মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এ পরিসংখ্যান ২০১৩ সালের। এখন বেশ আগেই এ সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ, এসএমই খাতে প্রায় চার কোটি জনবল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মরত। যারা এ রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন।

এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ অবস্থা যে সার্বিক অর্থনীতির জন্য দারুণ ক্ষতিকর সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এ পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুগছে। তাদের পুঁজি কম।’

তিনি বলেন, ‘এখন অনেক উদ্যোক্তা পণ্য তৈরি করতে পারছেন না। তাদের বিক্রি কমে গেছে। এছাড়া পরিবহন সংকট ও কাঁচামালের সংকট তৈরি হয়েছে। তাতে সবাই সমস্যায় পড়েছে। ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে এসেছে এ পরিস্থিতি।’

এসএমই ফাউন্ডেশন বলছে, দেশে বেশিরভাগ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের। তাই এসএমই উদ্যোক্তাদের সুবিধা দিয়ে শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পখাতের অবদান ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যেখানে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ২৮ শতাংশ। তবে চলমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে সার্বিক অর্থনীতির মতো এ খাতও মুখ থুবড়ে পড়বে।

এসএমই উদ্যোক্তাদের সংগঠন জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ (নাসিব) বলছে, চলমান অবরোধে উদ্যোক্তাদের বিক্রি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে।

নাসিবের সভাপতি মির্জা নুরুল গনী শোভন জাগো নিউজকে বলেন, হরতাল-অবরোধে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্তরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। করোনার পরে কিছুটা আমরা কাটিয়ে উঠছিলাম, তাতে এ পরিস্থিতিতে আমরা আবারও মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছি। বারবার ধাক্কা খাচ্ছি।

তিনি বলেন, ‘এখন উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রি নেই। বিক্রি না করতে পারলে উৎপাদন হচ্ছে না। শ্রমিক বসে আছে। এভাবে কতদিন চলবে। কিছুদিন পরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।’

মির্জা নুরুল গনী বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ বাজারে যেন এসএমই পণ্যের চাহিদা তৈরি হয় তার জন্য দরকার বাজার ও ক্রেতার সঙ্গে উদ্যোক্তাদের সংযোগ। সেটা এখন একদম হচ্ছে না। আবার বিভিন্ন মেলার এখন মৌসুম হলেও করা যাচ্ছে না। বছরের এ শেষ সময় দেশি-বিদেশি বড় বড় প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ছোট উদ্যোক্তাদের চুক্তি হয়, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সেটাও বন্ধ।’