ষ্টাফ রিপোর্টার :
রেমিট্যান্স কমার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে হুন্ডিতে লেনদেন। কিন্তু অদ্যাবধি তা বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শুধু রেমিট্যান্স বাড়াতে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক বিশেষ সুবিধা। এতে আসছে না কোনো ইতিবাচক ফল।
বরং নির্বিঘ্নভাবে ‘হুন্ডির পেটে’ যাচ্ছে রেমিট্যান্স। ডলারের দর বেঁধে দেওয়াতেই মূলত হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেনে উৎসাহিত হচ্ছেন প্রবাসীরা। কারণ ডলারের বিনিময়ে ব্যাংক দিচ্ছে কম টাকা। ব্যাংকের বাইরে দিচ্ছে বেশি।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, রেমিট্যান্স কমার বড় কারণ রেট বেঁধে দেওয়া। এটা হলো চরম ভুল। মানুষ যেখানে বেশি টাকা পেয়েছে সেখানে গেছে। সুতরাং হুন্ডি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এখানে হুন্ডির কোনো দোষ নেই। হুন্ডিতে যেতে মানুষকে বাধ্য করা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে (ওভার ইনভয়েস ও আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে) প্রচুর অর্থ পাচার হচ্ছে। আর রপ্তানি আয়ের মূল্য কম নির্ধারণ করায় প্রবাসীরা হুন্ডির আশ্রয় নিচ্ছেন। কারণ হুন্ডির রেট প্রতি ডলার ১১৫-১১৬ টাকা। আর ব্যাংক রেট দিচ্ছে ১০৭ টাকা। সুতরাং এত কমে তো প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাবেন না। এজন্য হুন্ডি বন্ধে উদ্যোগ জরুরি। অর্থাৎ ডলারের দর বেঁধে দেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এটা সম্পূর্ণভাবে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
এদিকে নানা উদ্যোগ নিয়েও রেমিট্যান্স বাড়াতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে কমছে। অর্থনীতির অন্যতম এ সূচকটির নেতিবাচক গতি দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে বিভিন্ন শর্ত শিথিল, চার্জ ফি মওকুফসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে আগামীতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার আশা করা হচ্ছে।
রেমিট্যান্স বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে-বৈধ উপায়ে ওয়েজ আর্নার্স রেমিট্যান্সের বিপরীতে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননা প্রদান করছে সরকার। রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ ও সহজীকরণের পাশাপাশি অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ন অর্থায়ন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ফিনটেক পদ্ধতির আওতায় আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার অপারেটরকে বাংলাদেশের ব্যাংকের সঙ্গে ড্রয়িং ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর চার্জ ফি মওকুফ করা হয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের সুবিধা বিবেচনায় দেশের বাইরে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যাংকগুলো নিজস্ব এক্সচেঞ্জ হাউজ খোলা রাখতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে ১৫২ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত ৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ১৪৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। চলতি অর্থবছরের টানা দুই মাস ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স বৈধ পথে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত আগস্ট মাসের ২০৩ কো?টি ৭৮ লাখ (২ দশমিক ০৩ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। তার আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। জুলাই মাসে পবিত্র ঈদুল আজহার কারণে দেশে বিপুল অঙ্কের প্রবাসী আয় এসেছিল। তবে আগস্টে বড় কোনো উৎসব ছিল না, তারপরও প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়ায়। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে এসে এই উল্লম্ফনে হোঁচট খায়। সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। সদ্যবিদায়ি অক্টোবরে আরও কমে ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলা?রে নেমে এসেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, চলতি বছরের অক্টোবরে আগের মাস সেপ্টেম্বরের তুলনায় রেমিট্যান্স কিছুটা কম এসেছে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে গত অর্থবছরের তুলনায় রেমিট্যান্স ২.০৩% বেশি এসেছে। রেমিট্যান্স একটি ফ্লো। মাসভিত্তিক এ প্রবাহে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে। মৌসুমি প্রভাব ও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় এ রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া প্রবাসী আয় বাড়াতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে-ফলে আশা করছি আগামীতে রেমিট্যান্স আহরণ ক্রমান্বয়ে বাড়বে।
অন্যদিকে ডলারের দাম নির্ধারণ নিয়ে সমন্বয়হীনতা প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এটাও রেমিট্যান্স কমার কারণ। এর ফলে বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে ডলারের দাম। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েও তা বাতিল বা স্থগিত করা হচ্ছে। সর্বশেষ যা ঘটেছে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসা করা ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সভায়। গত ৬ নভেম্বর রাতে সোনালী ব্যাংকে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জানা যায়, গত ৩১ অক্টোবর এবিবি ও বাফেদার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়-উচ্চ আয়ের প্রবাসী পেশাজীবীরা ব্যাংকের মাধ্যমে আয় পাঠালে প্রতি ডলারের জন্য ১০৭ টাকা করে দেওয়া হবে। আগে তারা পেতেন ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় আহরণে কোনো চার্জ বা মাসুলও নেবে না। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত ডলার ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা দামে একে অপরের কাছে বিক্রি করতে পারবে ব্যাংকগুলো। ওই সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল ও কাজী ছাইদুর রহমান।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রোববার সভায় বসেন এবিবি ও বাফেদার নেতারা। সভায় বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ আয়ের প্রবাসী পেশাজীবীদের পাঠানো আয়ে ডলারের দাম নিয়ে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, তা স্থগিত করতে বলেছে। এ ছাড়া ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা দামে অন্য ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করা যাবে না। সভায় উপস্থিত অন্য ব্যাংকাররা এমন সিদ্ধান্ত শুনে হতবাক হন। এবিবির নেতৃত্বে রয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ও বাফেদার নেতৃত্বে রয়েছে সরকারি ব্যাংকের এমডিরা। এরপর সভায় আলোচনা হয়, প্রবাসী আয় পাঠাতে যে খরচ হয়, তা মওকুফের ব্যবস্থা করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় উপস্থিত ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকের নিজস্ব এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে যে আয় আসে, তা মওকুফ করা যাবে। তবে ৯০ শতাংশের বেশি আয় আসে বহুজাতিক এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর মাধ্যমে। ফলে পুরো আয়ে মাসুল মওকুফ হবে না। সভায় সব প্রবাসী আয়ে মাসুল মওকুফের উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য বহুজাতিক এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরুর পরামর্শ দেওয়া হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে দেশীয় ব্যাংকগুলোর মালিকানাধীন এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো বন্ধের দিনেও প্রবাসী আয় সংগ্রহ করবে, যাতে আয় পাঠাতে প্রবাসীরা কোনো সমস্যায় না পড়েন। এছাড়া সভায় এখন থেকে রপ্তানি আয়ে নগদায়নে ডলারের দাম ১০০ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আগে যা ছিল ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা