এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি মিলিয়ে কমপক্ষে ১৮ মাস ক্লাস নেওয়া হয়। একাদশে প্রথমপত্র ও দ্বাদশে পড়ানো হয় দ্বিতীয়পত্র। পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকে দুটি পত্রই সমানতালে পড়ে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। অথচ এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা একাদশ ও দ্বাদশ মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে ১৫ মাস ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছেন। এতে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি ছিল। পরীক্ষার ফলাফলে যার প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২ মার্চ মাস থেকে ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের একাদশ শ্রেণিতে ক্লাস শুরু হয়। চলতি বছরের ৩০ মে শুরু হয় নির্বাচনী পরীক্ষা। নির্বাচনী পরীক্ষার পর দ্বাদশ শ্রেণিতে আর ক্লাস নেওয়া হয় না। ফলে এক বছর তিন মাস ক্লাস করে পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ের পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের।
চলতি বছরের ৩০ মে শুরু হয় নির্বাচনী পরীক্ষা। নির্বাচনী পরীক্ষার পর দ্বাদশ শ্রেণিতে আর ক্লাস নেওয়া হয় না। ফলে এক বছর তিন মাস ক্লাস করে পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ের পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের
এদিকে, চলতি বছরের এইচএসি পরীক্ষা শুরুর আগে কিছু শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামেন। তারা পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এমনকি ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডও ঘেরাও করেন। তাদের দাবি অযৌক্তিক বলে তা মানেনি শিক্ষা বোর্ড।
ওই সময় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকার দাবি করেছিলেন- ‘এটা কোনো সমস্যা নয়।’ তার ভাষ্য ছিল, ‘এমনিতেই তো এইচএসসির শিক্ষার্থীদের ১৮ মাসের বেশি ক্লাস নেওয়া হয় না। করোনার ক্ষত পুষিয়ে নিতে এবার একটু তো সেক্রিফাইস (ছাড়) করতে হচ্ছে।’
রোববার (২৬ নভেম্বর) এইচএসসির ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীদের কম সময় ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক তপন কুমার সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিখন ঘাটতি ছিল না তা-ও বলা যায় না। আবার খুব বেশি যে সেটা প্রভাব ফেলেছে, তা-ও নয়। ফলাফল স্বাভাবিক আছে। খারাপ কিছু হয়নি।’
এদিকে, বোর্ড চেয়ারম্যান বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও শিক্ষকরা শিখন ঘাটতির ধাক্কায় ফল খারাপ হয়েছে বলে মনে করেন। রাজধানীর বেশ কয়েকটি কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে কম সময় ক্লাস নেওয়ায় শিখন ঘাটতি ছিল বলে জানিয়েছেন তারা। তবে এ নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে চান না শিক্ষকরা
তেজগাঁও সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২২ সালের এইচএসসির ফল হলো ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আবার ২০২৩ সালের পরীক্ষাটাও একই বছরে হলো। সেটার ফলও নভেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করা হলো। সময়ের যে অল্প ফারাক এতেই তো শিখন ঘাটতি স্পষ্ট।’
শিক্ষার্থীদের মেধা কমে গেছে, সেটা তো নয়। ওরা এসএসসি দিয়ে ভালো রেজাল্ট করে এলো। এইচএসসিতে কেন ফেল করবে, জিপিএ-৫ কেন কম পাবে? কোন সিলবাসে পরীক্ষা হবে, সেটা ঠিক করে তাদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করলে এমনটা হয়তো ঘটতো না
ফল প্রকাশের পর নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও বলেন, ‘এবার যারা এইচএসসি পাস করলো, তারা করোনার সময়ে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়তো। অনলাইনে সেসময়ে ক্লাসের কারণে অনেকেরই ভিত্তি একটু দুর্বল ছিল। কিছু ঘাটতি ছিলই, এটা অস্বীকার করা যাবে না।’
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পাস করেছেন সিরাজুস সাদাত। দুটি বিষয়ে তুলনামূলক খারাপ করায় জিপিএ-৫ পাননি তিনি। সিরাজুস সাদাতের মা নীলুফার জেসমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘তখন তাড়াহুড়ো করে পরীক্ষাটা নিয়ে নিলো। দ্বিতীয় বর্ষে (দ্বাদশ) অল্প কয়েকদিন ক্লাস করে পরীক্ষায় বসতে হয়েছে ওদের। আরেকটু সময় পেলে ছেলেটা আমার ভালো প্রিপারেশন (প্রস্তুতি) নিতে পারতো। হয়তো এ প্লাসটা (জিপিএ-৫) পেয়ে যেতো।’
শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মেধা কমে গেছে, সেটা তো নয়। ওরা এসএসসি দিয়ে ভালো রেজাল্ট করে এলো। এইচএসসিতে কেন ফেল করবে, জিপিএ-৫ কেন কম পাবে? কোন সিলবাসে পরীক্ষা হবে, সেটা ঠিক করে তাদের প্রস্তুতিতে সহায়তা করলে এমনটা হয়তো ঘটতো না।’
ফেল করা শুধু শিক্ষার্থীর দায় নয় জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরীক্ষা কঠিন হয়েছে, শিক্ষার্থীরা পারেনি। এটা বলা মানে দায় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানো। আমি মনে করি- দায়টা শিক্ষকদের, নীতিনির্ধারকদের। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ামুখী করা শিক্ষক-অভিভাবকদের দায়িত্ব। তারা পড়েনি, লিখতে পারেনি; সেজন্য ফল খারাপ এটা বাজে অজুহাত।’
রোববার (২৬ নভেম্বর) দুপুরে ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে কম ক্লাস নেওয়ায় শিখন ঘাটতি ছিল কি না, প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। মন্ত্রী ২০২৩ সালের পরীক্ষার্থীদের বিষয়টি নিয়ে কথা না বলে ২০২৪ সালে যারা পরীক্ষা দেবে তাদের নিয়ে কথা বলে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান।
আগামীতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বিষয়ে আমরা খেয়াল রাখবো। তারা ন্যূনতম ক্লাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো কি না, ঠিকমতো সিলেবাস শেষ করা গেল কি না; সেগুলো আমরা যাচাই করে পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করবো
ডা. দীপু মনি বলেন, ‘আগামীতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বিষয়ে আমরা খেয়াল রাখবো। তারা ন্যূনতম ক্লাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো কি না, ঠিকমতো সিলেবাস শেষ করা গেল কি না; সেগুলো আমরা যাচাই করে পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করবো।’
রোববার (২৬ নভেম্বর) সকাল ১০টায় এইচএসসি ও সমমানের ফলাফলের সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী ও বোর্ড চেয়ারম্যানরা। এরপর বেলা ১১টায় শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইট ও স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফল প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত বছর ২০২২ সালে পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। সে হিসাবে এবার পাসের হার ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ কম। বোর্ডভিত্তিক ফলাফলেও সব বোর্ডে গত কয়েক বছরের চেয়ে এবার ফলাফল নিম্নমুখী।
অন্যদিকে সবচেয়ে ভালো ফল বলে বিবেচিত জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও এবার কমেছে। গতবারের চেয়ে এবার বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও জিপিএ-৫ পেয়েছেন গতবারের চেয়ে প্রায় ৮৪ হাজার কম। এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৯৫ শিক্ষার্থী। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন এক লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এ বছর জিপিএ-৫ কম পেয়েছেন ৮৩ হাজার ৯১৭ শিক্ষার্থী।