২৯ আগষ্ট ২০২৩
কোটিপতি কে না হতে চায়! তাও যদি হয় স্বল্প বিনিয়োগ আর শরিয়াহসম্মত। দুবাইভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ ইনকরপোরেটেডের (এমটিএফই) ছিল গ্রাহকের জন্য এ ধরনের লোভনীয় সব অফার। এসব লোভনীয় অফারের ঢোক গিলতে সময় লাগেনি বেশিদিন। অবশেষে ধরা খেয়ে এখন গ্রাহকের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
শরিয়াহসম্মত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে সামান্য বিনিয়োগে কোটিপতি হওয়ার লোভে পড়ে দেশের উপজেলা, গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষের কোটি কোটি টাকা খোয়া গেছে। শুধু তাই নয়, দেশ থেকে পাচার হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
প্রথমদিকে এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত প্রত্যেকেই ৬১, ২০১, ৫০১, ৯০১ ও ২ হাজার ডলার ডিপোজিট করেন। বেশি টাকা আয় করতে কেউ কেউ ৫ হাজার ডলারের বেশিও বিনিয়োগ করেছেন। কেউ জমানো টাকা বিনিয়োগ করেছেন, কেউবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আবার কেউ জমি বন্ধক রেখেও বিনিয়োগ করেন। কিন্তু গত ১৭ আগস্ট সিস্টেম আপগ্রেডের কথা বলে গ্রাহকদের টাকা তোলার সেবা বন্ধ করে এমটিএফই।
জানা গেছে, এমটিএফই-র অ্যাপের মাধ্যমে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে পরবর্তী মাস থেকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে পেতেন একজন বিনিয়োগকারী। এভাবে একজন থেকে আরেকজন অর্থাৎ যতজন বিনিয়োগ করবেন আগের ব্যক্তি তত বেশি লাভ পাবেন ভিত্তিতে এমটিএফই অফার দিতো।
একজন বিনিয়োগকারী নিজের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে এমটিএফই অ্যাপ ডাউনলোড করে অ্যাকাউন্টে লগইন করে নিজের করা বিনিয়োগ ও লাভ মুহূর্তেই দেখতে পেতেন। এছাড়া তার নিচে কতজন বিনিয়োগ করেছে সেটিও দেখা যেত। এমটিএফই-র অ্যাপটিতে ডিপোজিট, উইথড্রয়াল, ক্যাপিটাল ফ্লো, ট্রানজেকশন মুড, পারসোনাল ইনফরমেশন, ইনভাইট ফ্রেন্ডস ও কাস্টমার সার্ভিস ৭x২৪ নামে অপশন ছিল।
বাংলাদেশে এমটিএফইর ছিল না কোনো কার্যালয়, ছিল না কোম্পানির কোনো চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নাম-ঠিকানা। মোবাইলেই সব কাজ হতো। বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করতে এমটিএফই প্রতিনিধি বা সিইও নিয়োগ করতো। দেশের বিভিন্ন জেলায় এ রকম শত শত প্রতিনিধি বানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এখন পর্যন্ত চার শতাধিকের বেশি সিইও রয়েছে বলে জানা গেছে। দেশে কোনো কার্যালয় না থাকলেও গত বছরের শেষ দিক থেকে এমটিএফইর কার্যক্রম শুরু হয়। ঘরে বসে সহজে আয়ের পথ বলে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে ব্যাপক প্রচারণা চালায় তারা। বিভিন্ন ভিডিও ও বিজ্ঞাপন দেখেও ভুক্তভোগীরা আগ্রহী হন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমটিএফই-র গ্রাহক সংখ্যা ছিল আট লাখ। লাখ লাখ গ্রাহক থেকে অর্থ হাতিয়ে এমটিএফই প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আসলে কত টাকা এমটিএফই দেশ থেকে পাচার করেছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি এখনও। তবে, এখন পর্যন্ত চলা তদন্তে এটা প্রায় নিশ্চিত এমটিএফই দেশ থেকে টাকা পাচার করে থাকলে, সেটি মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে করেছে। পাচার হওয়া টাকার পরিমাণও কয়েক হাজার কোটি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, একটি বিষয় তদন্ত করতে গেলে সেটির গ্রাউন্ড প্রয়োজন হয়। মামলা কিংবা ভুক্তভোগীর সাহায্য ছাড়া সঠিকভাবে কোনো বিষয় তদন্তে উঠে আসে না। এমটিএফই-র বিষয়ে প্রথমে ভুক্তভোগীদের মামলা করতে হবে। এরপর বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা হবে।
কেমন ছিল এমটিএফই-র কার্যক্রম তা জানা যায় ভুক্তভোগী গ্রাহকদের কাছ থেকেই।
যশোরের কেশবপুরেই অনলাইন অ্যাপ এমটিএফই-র মাধ্যমে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন অন্তত ২ হাজার গ্রাহক। রাতারাতি বড় লোক হওয়ার প্রলোভনে গ্রাহকরা বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারিয়েছেন। এখন লোকলজ্জার ভয়ে তারা মুখ খুলছেন না।
জানা যায়, কেশবপুর শহরের ত্রিমোহিনী মোড়ে একটি পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয়তলা ভাড়া নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে এমটিএফই কার্যক্রম শুরু করা হয়। জামাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি প্রথমে এটি শুরু করেন। তিনি সাতক্ষীরার বাসিন্দা বললেও তার পুরো ঠিকানা কেউ জানেন না। দুই বছর আগে তিনি শহরের আবদুল ওহাব মার্কেটে একটি জুয়েলারির দোকান দেন। তার মাধ্যমে অনেকেই এমটিএফইয়ে বিনিয়োগ করেন। দ্রুত বিপুল অর্থের মালিক হওয়া যাবে এমন প্রলোভনে পড়ে কেশবপুরের বেকার যুবক, শিক্ষক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেন। বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ লাভও পেয়েছেন।
বগুড়ায় অন্তত ২০০ জনের সিইও ছিলেন রাম মোহন দাস নামে এক ব্যক্তি। শুধু তার তত্ত্বাবধানে ১০ কোটি টাকার ওপর লেনদেন হতো। অনেকে লাখ লাখ টাকা হারিয়ে আজ নিঃস্ব। বিষয়টি নিয়ে দেশের অন্য স্থানের মতো এ জেলায়ও আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তবে ভুক্তভোগীদের কেউ লোকলজ্জার ভয়ে প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেননি।
এমটিএফই-র সিইও রাম মোহন দাস সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, প্রতারণার বিষয়টি তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। তার আওতায় দুই শতাধিক হিসাব ছিল। এসব হিসাবে লেনদেন হতো ১০ কোটি টাকার ওপরে। তার নিজের বিনিয়োগ ছিল তিন লাখ টাকা। হঠাৎ ধনী হওয়ার আশায় সবাই বিনিয়োগ করেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে এমটিএফইয়ের একজন সিইও জাগো নিউজকে বলেন, ৬১ ডলার বাংলাদেশি টাকায় ৬ হাজার টাকার বেশি অ্যাপে ডিপোজিট করি। পরের মাসেই লাভ আসে দেড় হাজার টাকা। এরপরের মাসে ২০১ ও পরের মাসে ৫০১ ডলার বিনিয়োগ করি। প্রায় প্রতি মাসে লাভ আসতে থাকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার কাছাকাছি। এর মধ্যে বন্ধু, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের এমটিএফই-র অ্যাকাউন্ট খুলতে বলি। আমার কথায় বিশ্বাস করে প্রায় ৬০ জনের বেশি আমার রেফারেন্স দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলে। তাদের যে লাভ হয় সেখান থেকে আমার অ্যাকাউন্টেও লাভ আসতে থাকে। গত কয়েক মাসে এভাবে আমি নিজে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টাকার মতো লাভ করেছি।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমএটিএফই দেশ থেকে কত টাকা পাচার করেছে তা একমাত্র বলতে পারবে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষেও জানা সম্ভব নয়। টাকা যদি পাচার হয় তাহলে বিএফআইইউতে অ্যালার্ট যাওয়ার কথা। তাই বিএফআইইউ ছাড়া এ বিষয়ে সঠিক তথ্য কারও কাছে থাকার কথা নয়।
অর্থপাচার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কর্মকর্তারা বলছেন, এমটিএফই নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে এমটিএফই কত টাকা লেনদেন করেছে মোবাইল ব্যাকিং বা অন্য মাধ্যমে, তার চিত্র উঠে আসবে। বিএফআইইউ গত বছর থেকে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে অনলাইন জুয়া, বেটিং, বৈদেশিক মুদ্রা ও ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন ঠেকাতে কাজ করছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, এমটিএফই-র বিষয়ে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিএমপির আওতাভুক্ত ৫০ থানার মধ্যে কোনোটিতে অভিযোগ আসেনি। যদি কোনো ভুক্তভোগী অভিযোগ দাখিল করেন পুলিশ তদন্ত করে বিষয়টি দেখবে। তবে ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে ডিএমপির ডিবি ও সিটিটিসির সাইবার ইউনিট ছায়া তদন্ত শুরু করেছে। ভুক্তভোগী ও সিইওদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও ব্যাটালিয়নগুলো ইতো মধ্যে কাজ শুরু করেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। এমটিএফই-র মাধ্যমে মোট কত লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সিইও কারা, তাদের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। লুণ্ঠিত টাকার পরিমাণ নির্ণয় ও প্রতারক চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে কাজ চলছে।
সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ জাগো নিউজেক বলেন, বাংলাদেশে কোনো অফিস না থাকলেও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ঘরে বসে সহজে আয়ের পথ বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। এমটিএফই-র রেজিস্ট্রেশনের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর জমা দিতে হয়েছে গ্রাহকদের। ভার্চুয়ালি ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডলার কেনাবেচা করা হলেও লভ্যাংশ দেওয়া হতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এসবের ফুটপ্রিন্ট রয়ে গেছে। ইতোমধ্যে অভিযোগ নিয়ে অনেক গ্রাহক সিআইডিতে আসতে শুরু করেছেন। তাদের মামলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, শুধু এমটিএফই নয়, দেশে এখনও সক্রিয় আছে অনিবন্ধনকৃত মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনভিত্তিক এ ধরনের প্রতারক চক্র। যেখানে বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, এমএলএম ব্যবসা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ ও নিষিদ্ধ। অ্যাপস ও অনলাইনভিত্তিক যেকোনো ব্যবসায় বিনিয়োগকারীদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতনতা দরকার।
টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এমএটিএফই অ্যাপটির বিষয়ে বিটিআরসির কাছে এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেনি। ফিজিক্যালি অথবা ডিজিটালি অপরাধ দমন করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার অংশ হিসেবে যদি মনে করে অ্যাপটি বন্ধ করতে পারে। তবে ডিজিটাল এই দুনিয়ায় প্রতিটি জায়গায়ই তালা মারার মতো সক্ষমতা নেই। অ্যাপস বন্ধ করবে কী দিয়ে? বাংলাদেশ থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি পাচার হয়েছে, ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধ। এটা বন্ধ করা উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের। সে ক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয় সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক বলতে পারবে, বিটিআরসির বিষয় নয় এটি।