উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এক যুগ আগে। এতদিনে এসে তার বাস্তবায়ন দেখছে চট্টগ্রাম বন্দর ক্যাপিটাল ড্রেজিং। আর এ কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই মিলছে সুফল। নাব্য বেড়েছে কর্ণফুলী নদীতে। সচল হয়েছে বিভিন্ন জেটি। সেখানে ভিড়ছে লাইটার (ছোট আকারের জাহাজ)। ফিরিঙ্গিবাজার ফিশারিঘাটে ভিড়েই এখন মাছসহ বিভিন্ন পণ্য খালাস করতে পারছে মাছ ধরা ট্রলার ও নৌযান। কমেছে ভোগান্তি ও পরিবহণ ব্যয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুফল অব্যাহত রাখতে চাইলে ড্রেজিংও অব্যাহত রাখতে হবে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগরীর ‘সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর’ পর্যন্ত অন্তত ৮টি খালের কয়েক হাজার টন বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। এ কারণে নদী তীরবর্তী বিশাল এলাকায় জেগে ওঠে চর। ৮০০ মিটার প্রশস্ত নদী এ অংশে নেমে এসেছিল ৪০০ মিটারে। নাব্য হারানোর কারণে ফিরিঙ্গিবাজার ফিশারি ঘাটে ভিড়তে পারত না মাছের ট্রলার ও পণ্যবাহী নৌযান। সদরঘাট লাইটার জেটিগুলোতে ভিড়তে পারত না জাহাজ। কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর নিচেও পলি জমে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় চরমভাবে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কর্ণফুলীর নাব্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। ২০১১ সালে মালয়েশিয়ান মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। ওই কোম্পানি কাজ শুরু করার দুই বছর না যেতেই কাজ ফেলে পালিয়ে যায়। কাজের চেয়েও অতিরিক্ত বিশাল অঙ্কের টাকা তুলে নেয় তারা। অন্য একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে ড্রেজিংয়ের সাব-কন্ট্রাক্ট দেয় প্রতিষ্ঠানটি। চীনা কোম্পানি চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ৩২ ইঞ্চি ব্যাসের কাটার সাকশান ড্রেজার ব্যবহার করেও ওই কোম্পানি খননে সক্ষম হয়নি। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে চুক্তি বাতিল করে। এ অবস্থায় নতুন করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) দিয়ে সমীক্ষা চালানো হয়। বুয়েট সমীক্ষা প্রতিবেদনে জানায়, নদীর তলদেশে ১৩ ফুট পর্যন্ত পলিথিনের স্তর রয়েছে। কিন্তু বুয়েটের ধারনার বাইরে পরে নদীর তলদেশে কোথাও কোথাও পলিথিনের স্তর মিলেছে ২১ ফুট পর্যন্ত।
সূত্র জানায়, পরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নৌবাহিনীকে দিয়ে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেয়। নৌ বাহিনীর সহযোগী হিসাবে কাজ করে ই-ইঞ্জিনিয়ারিং নামের সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় নৌবাহিনীর সংশ্লিষ্ট উইং। নদীর তলদেশে থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার পলিমাটি উত্তোলনের কথা ছিল চুক্তিতে। পরে প্রকল্প সংশোধন করে ৫১ লাখ ঘনমিটার পলিমাটি উত্তোলনের সিদ্ধান্ত হয়। এ অবস্থায় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকায়।
কাজ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান যে কোনো মূল্যে খনন শেষ করে এর সুফল দিতে আটঘাট বেঁধে নামে। তারা অতীতের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার পথে হাঁটতে চায়নি। তাই খননে ব্যবহার করে বিশ্বখ্যাত আইএইসসি ব্র্যান্ডের ৩টি কাটার সাকশান ড্রেজার, লংবুম এস্কেভেটর, শর্টবুম এস্কেভেটর, ভাসমান বার্জ, গ্রাব ড্রেজারসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও খনন চলে নিরবচ্ছিন্নভাবে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে চলমান ড্রেজিং প্রকল্পে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এরইমধ্যে ড্রেজিংয়ের ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড্রেজিংয়ের মধ্যদিয়ে প্রায় মরতে বসা কর্ণফুলী প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নদী ফিরে পেয়েছে স্বাভাবিক গতি। বৃদ্ধি পেয়েছে নাব্য। সচল হয়েছে ৪০০ মিটার লাইটার জেটি। যেখানে ৩-৪ মিটার ড্রাফট বা গভীরতা বেড়েছে। এসব জেটি ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দর বছরে আয় করছে অন্তত ৮০ কোটি টাকা। সদরঘাটের ৩ লাইটার জেটিতে শুরু হয়েছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
সূত্র আরও জানায়, নাব্য বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরে এখন ছোট-বড় শত শত লাইটার জাহাজ ও মাছধরা ট্রলার নোঙর করছে। নতুন ফিশারিঘাট এলাকায় ঘাটে ভিড়েই সরাসরি ট্রলার থেকে মাছ খালাস করা যাচ্ছে। আগে যেখানে নদী তীরের ২০০-৩০০ মিটার দূরে নোঙ্গর করে মাছ নামাতে হতো-এখন সেই ভোগান্তি আর পোহাতে হচ্ছে না। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ থেকে শত শত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সাশ্রয়ী খরচে নৌপথে নিয়ে যাচ্ছে পণ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড্রেজিং চলমান থাকলে কর্ণফুলী নদী ভরাটের হাত থেকে রক্ষা পাবে। দিন দিন আরও বাড়বে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। জলাবদ্ধতা নিরসনেও ক্যাপিটাল ড্রেজিং বড় ভ‚মিকা রাখবে। চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘অবশ্যই ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের সুফল বন্দর কর্তৃপক্ষ পেতে শুরু করেছে। সদরঘাটের লাইটার জেটিগুলো সচল হয়েছে। শাহ আমানত সেতুর নিচ দিয়ে পানির প্রবাহও বেড়েছে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে ড্রেজিংয়ের কারণে। তবে এটা ধরে রাখতে সুষ্ঠু মেইনটেন্যান্সের বিকল্প নেই। খাল থেকে পলিথিন ও বর্জ্য নদীতে এসে পড়া বন্ধ করতে হবে। এজন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটি প্রকল্প নিয়েছে বলে জানি।’