লেখকঃ মোঃ হায়দার আলী। । শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, যে দেশের মানুষ যত শিক্ষিত সে দেশ তত উন্নত। বর্তমান সরকার শিক্ষা বান্ধব সরকার, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাডেমিক ভবণ, রাসেল ডিজিটাল ল্যাবসহ মানসম্মত উন্নত পাঠদান নিশ্চিত করতে নানামূখি উদ্দ্যেগ গ্রহন করেছেন। কিন্তু একটি কুচক্রীমহ সরকারের সুনাম, উন্নয়ন নষ্ট করে দিচ্ছেন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে। এদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর থেকে আরো কঠোর হতে হবে। সে যে দলের, মতের হউক না কেন? কোন ভাবে ছাড় দেয়া যাবে না। জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় হাতে নিয়ে যে সংবাদটি আমার নজর কড়েছে সেটি হলো পাবলিক পরীক্ষা এসএসসির প্রশ্ন ফাঁসের নিউজটি। নিউজটি পড়তে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। এ প্রশ্ন ফাঁসের সাথে শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষকগণ জড়িত। তাই পাঠকদের জন্য দুটি পত্রিকার সংবাদটি তুলে ধরলাম।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় সন্দেহের তালিকায় কমিটির সব সদস্য
দিনাজপুর বোর্ডে দশ বিষয়ে প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কা প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের সাত নয়, দশ বিষয়ের প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কা রয়েছে।
শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে ১৫ সেপ্টেম্বর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এর দু-তিন দিন আগে উপজেলার ট্রেজারিতে প্রশ্নপত্র সর্টিং (বাছাই) হয়েছে। এ সময় উপজেলা পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে এ সময়ই কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীর নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান প্যাকেটসহ এসব প্রশ্ন বের করে নেন, যা পরে প্রশাসন তার কক্ষ থেকে এসব উদ্ধার করে।
সব সদস্যের যোগসাজশ ছাড়া একা কেন্দ্রসচিবের পক্ষে এই দুঃসাহসিক কাজ করা সম্ভব নয়। এমনটিই মনে করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি।যেসব বিষয়ে প্রশ্নফাঁসের শঙ্কা করা হচ্ছে সেগুলো হলো : গণিত, কৃষিশিক্ষা, রসায়ন, পদার্থ, উচ্চতর গণিত এবং জীববিজ্ঞান। এছাড়া সন্দেহের তালিকায় আছে বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি জেলা পুলিশের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে। এদিকে প্রথম ছটি বিষয়ে পরীক্ষা হবে নতুন প্রশ্নে। আর বাকি চারটির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত চারটি পরীক্ষা বাতিল করেছে। বৃহস্পতিবারই বাতিল পরীক্ষার নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়। নতুন রুটিন অনুযায়ী ১০ অক্টোবর গণিত, ১১ অক্টোবর কৃষিশিক্ষা, ১৩ অক্টোবর রসায়ন এবং ১৫ অক্টোবর পদার্থ বিজ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়া হবে। এছাড়া উচ্চতর গণিত এবং জীববিজ্ঞানের প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। কিন্তু এ দুটি পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কারণ আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর পরীক্ষা দুটি নির্ধারিত আছে। এর আগেই এ পরীক্ষা দুটির প্রশ্ন ছাপানো সম্ভব।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক ফারাজ উদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় সরেজমিন কাজ শুরু করেছে। এছাড়া মাউশির নির্দেশে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। তাতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রহমানের দায়িত্বে অবহেলা প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য তাকে বৃহস্পতিবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া এ ঘটনায় পুলিশ নতুন করে আরও ৩ জনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে। তারা গত বুধবার থেকেই পুলিশের হেফাজতে ছিলেন। তিনজনের মধ্যে আছেন নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন ও পদার্থবিজ্ঞানের হামিদুল ইসলাম। এছাড়া অফিস সহায়ক সুজন মিয়াও গ্রেফতার হয়েছেন। এ নিয়ে ৬ জন গ্রেফতার হলেন। তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে এ ঘটনায় আরও অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন বলে মনে করছেন পরীক্ষা বিশেষজ্ঞরা। কেননা প্রশ্নপত্র উপজেলায় পৌঁছানোর পর পরীক্ষা শুরুর ২-৩ দিন আগে ‘উপজেলা পাবলিক পরীক্ষা কমিটি’র সদস্যদের সামনেই বাছাই করা হয়েছে। ওইদিন ছাড়া অন্য তারিখে প্রশ্ন ট্রেজারি থেকে সরানো সম্ভব নয়। কেননা, যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা থাকে, সেদিন কেবল সেই প্রশ্ন নেওয়া হয়। যদি তাই হয়, তাহলে এত সদস্যের সামনে কেন্দ্রসচিব প্রশ্ন কীভাবে সরালেন-এটি এখন বড় প্রশ্ন।
তাই ধারণা করা হচ্ছে, এই ঘটনায় অন্যরাও জড়িত থাকতে পারেন। তাই মামলার বাদী শেষ পর্যন্ত প্রশ্নফাঁসের আসামি হবেন কি না, সেটাও তদন্তেই বেরিয়ে আসবে বলে মাউশি সূত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘পরীক্ষার দু-একদিন আগে প্রশ্নপত্র সর্টিং করা হয়। মূল প্রশ্ন থাকে ফয়েল পেপারে, যার উভয় মুখ মেশিন দিয়ে লাগানো থাকে। এর ওপরে প্রশ্নসংখ্যা ও বিষয়ের নাম থাকে। আবার ফয়েল পেপারের খাম কাগজের আলাদা খামে থাকে। সেটি পরীক্ষা কমিটির সবার সামনে খুলে সর্টিং করা হয়। তাই ঘটনা যা ঘটার, তা পরীক্ষার আগেই ঘটে থাকতে পারে। কেননা অন্যদিন অন্য কোনো বিষয়ের প্রশ্নের খাম সরানো সম্ভব নয়। এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার ৬ জনকেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে এক নম্বর আসামি লুৎফর রহমানকে বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। ভুরুঙ্গামারী কোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল রেজিস্ট্রার অফিসার (জিআরও) সিরাজুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আজাহার আলী এই শিক্ষকের ৩ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছেন। কিন্তু আসামিপক্ষে জামিনের আবেদন করা হয় আদালতে। তবে বিজ্ঞ বিচারক মো. সুমন আলী রিমান্ড ও জামিন শুনানির জন্য ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করে আদেশ দেন। এ ঘটনায় ৪ জন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতসহ ১০/১৫ জন আসামি। তাদের বিরুদ্ধে বুধবারই পাবলিক এক্সজামিনেশন অফেন্স অ্যাক্ট ১৯৮০-এর ৪/১৩ ধারায় মামলা করা হয়।
একই তারিখের দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় কুড়িগ্রমে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় আরো ৩ গ্রেপ্তার: শিক্ষা বোর্ডের তদন্ত শুরু মোট গ্রেপ্তার ৬ জন, পরীক্ষার নতুন রুটিন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বরখাস্ত। শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, কুড়িগ্রামর জেলার ভূরুঙ্গামারীতে চলতি এসএসসি পরীক্ষার চাঞ্চল্যকর প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ওই বিদ্যালয়ের আরো দুই শিক্ষক এবং একজন অফিস সহায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হলেও বৃহস্পতিবার তাদের প্রশ্ন ফাঁসের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলো নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন, পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম এবং অফিস সহায়ক সুজন মিয়া। এর আগে বুধবার একই স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে এ মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়ালো ৬জনে। বৃহস্পতিবার দুপুরে নতুন করে গ্রেপ্তারকৃত ৩জনকে কুড়িগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ আলসগীর হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অপরদিকে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দায়িত্বে অবহেলা এবং অসদাচরণের দায়ে ভুরুঙ্গামারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ কামরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সংশোধিত পত্রের বরাতে জানান, স্থগিত চারটি পরীক্ষার নতুন সময় সূচি মোতাবেক আগামী ১০ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে গণিত (আবশ্যিক) ১০, কৃষি শিক্ষা (তত্ত্বীয়) ১১, রসায়ন (তত্ত্বীয়) ১৩ এবং পদার্থ বিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া অপর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় স্থগিত ৪টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সাথে নতুন করে জীব বিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) এবং উচ্চতর গণিত (তত্ত্বীয়)সহ মোট ৬টি বিষয়ের ইতোপূর্বে সরবরাহকৃত প্রশ্নপত্র বাতিল করা হলো।তাই আগামী ২৪/০৯/২২ তারিখের মধ্যে উক্ত বাতিলকৃত প্রশ্নপত্রসমুহ ট্রেজারী অফিসসমুহে কঠোর নিরাপত্তার সাথে আলাদা করে পৃথক ট্রাঙ্কে সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করা হলো। রংপুর বিভাগের জেলা প্রশাসককে এ অনুরোধ জানানো হয়। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস স্বাক্ষরিত আদেশের বরাতে জানান, চলমান এসএসসি পরীক্ষায় ভুরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস সংক্রান্ত ঘটনায় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (চলতি দায়িত্ব) মোঃ আব্দুর রহমান কে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে সরকারি কর্মচারী ) শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮এর (২)(খ) (আ) অনুসারে অসদাচরণের দায়ে তাকে ২২/০৯/২২ তারিখ হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।
তিনি আরো জানান, প্রশ্ন ফাঁসের এঘটনায় শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালকের পক্ষে আমি (জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ শামছুল ইসলাম) বৃহস্পতিবার নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছি। সহকারী প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান সহ অন্যান্য শিক্ষকদের জবানবন্দী রেকর্ড করেছি। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সাথে জড়িত কেউ রেহাই পাবেনা। এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত শিক্ষা বিভাগের কারো কোন দায়িত্বে অবহেলা অনিয়ম কিংবা দুর্নীতির সাথে জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে শিক্ষা বিভাগ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে।
জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম আরো জানান, দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গঠিত তিন সদদ্যের তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে কুড়িগ্রাম পৌঁছেছেন। এ কমিটির আহ্বায়ক দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক মোঃ ফারাজ উদ্দিন তালুকদার। তদন্তটিমের অন্য সদস্যরা হলেন, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (উমা) প্রফেসর মোঃ হারুন অর রশিদ মন্ডল এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মোঃ আকতারুজ্জামান। তাঁরা তাদের তদন্ত কার্যক্রমও শুরু করেছন। এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত ) আজাহার আলী জানান, প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত মামলায় নতুন করে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন, পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম এবং অফিস সহায়ক সুজন মিয়া। এ নিয়ে এ মামলায় এখন পর্যন্ত ৬জনকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণের ভিত্তেতে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। একজন আসামীর রিমান্ড আবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে করা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ভুরুঙ্গামারী কোর্টের দায়িত্ব প্রাপ্ত জেনারেল রেজিস্ট্রার অফিসার (জিআরও) সিরাজুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত ) আজাহার আলী এক নম্বর আসামী নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানের ৩দিনের রিমান্ড আবেদন করেছেন। অপরদিকে আসামী পক্ষে জামিনের আবেদন করা হয় আদালতে। চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ভুরুঙ্গামারী কোর্টের বিজ্ঞ বিচারক মোঃ সুমন আলী রিমান্ড এবং জামিন শুনানীর জন্য আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করে আদেশ দেন।
উল্লেখ্য, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় চলতি এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি ১ম এবং ২য় পত্রের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যম কর্মীদের নজরে আসলে নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। অনেক নাটকীয়তার পরে মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিব ও নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ভুরুঙ্গামারী থানায় এব্যাপারে ৪জন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১০/১৫জনকে আসামী বুধবার পাবলিক এক্সজামিনেশন অফেন্স এ্যাক্ট ১৯৮০ এর ৪/১৩ ধারায় মামলা রুজু করেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আদম মালিক চৌধুরী। তিনি চলতি এসএসসি পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা (ট্যাগ অফিসার)। এ ঘটনায় বুধবার দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ কামরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে চলমান এসএসসি পরীক্ষার গণিত, পদার্থ,কৃষি এবং রসায়ন বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষনা করা হয়।
অভিনব কায়দায় প্রশ্ন ফাঁস এবং যে ভাবে রহস্য উৎঘাটন হয়
ভুরুঙ্গামারী থানায় প্রশ্ন বাছাইয়ের (সর্টিং) সময় ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ঐ কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপজেলা মাধ্যমিক অফিসার আব্দুর রহমানের যোগসাজসে বাংলা ১ম পত্রের প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের ভিতর বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের প্রশ্নপত্রের একটি করে খাম ঢুকিয়ে নেন এবং প্যাকেট সীলগালা করে তার ওপর স্বাক্ষর করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। বাংলা ১ম পত্রের পরীক্ষার দিন যথানিয়মে থানা থেকে বাংলা ১ম পত্রের প্যাকেট এনে তা খুলে বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের খামটি কৌশলে সরিয়ে ফেলেন। এসময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত ট্যাগ অফিসার বোর্ডের দেয়া তালিকা অনুযায়ী পাঠানো প্রশ্নেপত্রের খাম গণনা করার নিয়ম থাকলেও তারা দায়িত্ব অবহেলা করে তা করেননি। পরে প্রধান শিক্ষক কয়েকজন শিক্ষকের সহায়তায় ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের উত্তরমালা তৈরী করে ঐ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে (চুক্তিতে সবসেট) ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করেন। পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস হওয়া উত্তর পত্রের সাথে পরের দিন পরীক্ষার প্রদত্ত প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া যায়। পরে সামাজিক মাধ্যমে এসব উত্তর পত্র ছড়িয়ে পড়ায় তা নেবার জন্য শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকগণ ছুটোছৃুটি করেন। প্রতিটি উত্তরপত্রের কপি ২শ হতে ৫শ টাকায় বিক্রি হয় গোপনে।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনাটি স্থানীয় সাংবাদিকদের নজরে এলে বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবগত করা হলে তারা প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেন। পরে ইংরেজি ২য় পত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফঁাস হওয়ায় নড়েচড়ে বসেন পুলিশ ও প্রশাসন। মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) ইংরেজি ২য় পত্র পরীক্ষা দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপক কুমার দেব শর্মা, সহকারী পুলিশ সুপার মোর্শেদুল হাসান, ওসি আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল প্রধান শিক্ষকের কক্ষে অভিযান চালিয়ে গণিত, কৃষি বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের প্রশ্নপত্র পায়। যে বিষয় গুলোর পরীক্ষা এখানো হয়নি। উল্লেখ্য, পুলিশ জানতে পারে একইভাবে ইংরেজি ১ম পত্রের পরীক্ষার প্যাকেটে এই প্রশ্নগুলো ঢুকানো ছিলো। আর এ প্রশ্নগুলো প্রধান শিক্ষকের কক্ষে রয়েছে নিশ্চিত হয়ে তারা অভিযান চালায়। পরে বিকালে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান ও প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানকে থানায় আনলেও রাতে প্রধান শিক্ষককে আটক করা হয় এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে ইংরেজি শিক্ষক আমিনুর রহমান রাসেল, চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক জোবায়ের হোসাইনকে আটক করে এবং বুধবার ভোরে হামিদুল ইসলাম, সোহেল আল মামুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে। মামলার অপর আসামী ক্লার্ক আবু হানিফ পালিয়ে যায়। প্রশ্নফঁাসের ঘটনায় মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে নয়টার দিকে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পুলিশ সুপার আল আসাদ মোঃ মাহফুজুল ইসলাম, দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপক কুমার দেব শর্মা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কক্ষে প্রায় তিন ঘন্টাব্যাপি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এরপরই সিদ্ধান্ত হয় মামলা করার এবং প্রশ্ন ফঁাস হওয়া চারটি পরীক্ষা স্থগিত করার। পরে দিনাজপুর বোর্ডের চেয়ারম্যান দিনাজপুরে ফিরেগিয়ে বুধবার (২১/০৯/২২) বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণিত, পদার্থ, রসায়ন এবং কৃষি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেন।
দুটি পত্রিকা খুবই গুরুত্বসহ সংবাদটি প্রকাশ করেছন। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা মেধাবীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তারা হতাশায় ভুগছে। ভাবছে- আমি এত পরিশ্রম করে ভালো ফলাফল করতে পারলাম না, আমার স্বপ্ন নষ্ট হয়ে গেল; অথচ আমার সহপাঠী পরিশ্রম না করেই ভালো ফলাফল করল! এ ধরনের হতাশা একজন শিক্ষার্থীর মেধাকে ধ্বংস করে দেয়। আস্তে আস্তে মেধাশূন্য করে তরুণ সমাজকে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি এ ধারায় চলতে থাকে, তাহলে বাঙালি জাতি তৃতীয় বিশ্বের তৃতীয় শ্রেণীর মেধাসম্পন্ন জাতিতে পরিণত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
একটি রাষ্ট্র তখনই উন্নত হয়, যখন এর শিক্ষা কাঠামো এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্তরগুলো স্বচ্ছ ও সুগঠিত হয়। তাই প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে রাষ্ট্রকে এখনই জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। পাবলিক পরীক্ষায় নতুন নিয়ম অনুযায়ী সচিব ব্যতীত অন্য কেউ পরীক্ষাকেন্দ্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। অর্থাৎ দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা, এমনকি পরীক্ষার্থীরাও ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। এটি অবশ্যই একটি ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু জালিয়াতি রোধে তা যথোপযুক্ত নয় বলেই মনে হয়। কেননা প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকে সাধারণত পরীক্ষার আগের রাতে কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে। এজন্য প্রত্যেক শিক্ষা বোর্ডে মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে। অন্যান্য সদস্য হবেন বিভাগীয় শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, বিভাগীয় শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা পুলিশ সুপার। সব থেকে কার্যকর পদক্ষেপ হল ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধ আইন’ প্রণয়ন করা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অজস্র আইন আছে, কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর করতে মনিটরিং সেলের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে। প্রশ্ন ফাঁসকারী এবং প্রশ্ন গ্রহণকারী উভয়কে সমানভাবে অপরাধী গণ্য করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তবেই আইনের সুফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। যেহেতু সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও জালিয়াত চক্রকে ঠেকাতে পারছে না, তাই কঠোর আইনি পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। রাষ্ট্রকে মেধার যত্ন নিতে হবে দেশ এবং জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য। চীন, ভারত, কোরিয়া যেখানে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক খাতে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়ে বিশ্ব শাসন করতে চাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থার অচলাবস্থাই কাটিয়ে উঠতে পারছে না! হায়, কী দুভার্গ্য আমাদের! বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আমলা নয়, মানুষ সৃষ্টি করুন। মানুষ সৃষ্টি করতে হলে অবশ্যই শিক্ষা ব্যবস্থা স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে। মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। এজন্য রাষ্ট্র অতি দ্রুত বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেবে। পাশাপাশি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে সোচ্চার হতে হবে।
দেশে দুর্নীতি ও অনৈতিকতা কতটা প্রসারিত হয়েছে, তা বোঝা যায় শিক্ষক কর্তৃক প্রশ্নফাঁসের ঘটনা থেকে। চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় দিনাজপুর বোর্ডের অধীনে কুড়িগ্রাম জেলার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সাতটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কেন্দ্র সচিব কয়েকজন সহযোগী শিক্ষকের সহায়তায় প্রস্তুত করেন উত্তরপত্রও ফাঁস করেছেন। এরপর তা নিজের স্কুলের অনেক শিক্ষার্থীর কাছে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা করে বিক্রি করেন।শিক্ষার্থীরা তা আবার ৫০০ টাকায় বিক্রি করে। এভাবে একপর্যায়ে তা জানাজানি হয়ে যায়। এরপর স্থানীয় প্রশাসন ওই শিক্ষকের কক্ষে অভিযান চালায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় প্রশ্নপত্র।
দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রকোপ কিছুটা কমে এলেও কয়েক বছর আগে সরকারি চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অহরহই ঘটেছে। এর আগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। তবে সেসব ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে মূলত ডিজিটাল ডিভাইস তথা প্রযুক্তির মাধ্যমে।
কিন্তু এবারের ঘটনা আরও ন্যক্কারজনক। প্রশ্নফাঁসে সরাসরি শিক্ষক, এমনকি প্রধান শিক্ষকও যুক্ত হওয়ায় ভবিষ্যতে দেশে কী ধরনের মানবসম্পদ তৈরি হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দিক বলেছেন, ‘আমরা কাকে বিশ্বাস করব? প্রশ্নপত্র আনা-নেওয়ার দায়িত্ব যার ওপর দিলাম, শুনলাম তিনিই প্রশ্নফাঁস করেছেন। তাহলে কোথায় বিশ্বাস রাখব? ছাত্ররা কী শিখবে?’
বস্তুত এ প্রশ্ন আমাদের সবার। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করা একটি গুরুতর অপরাধ। আর এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যখন স্বয়ং শিক্ষক যুক্ত হয়ে পড়েন, তখন তা বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, এ ঘটনা সমাজের আশঙ্কাজনক অবক্ষয়েরও নির্দেশক। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা একদিকে যেমন জাতির মেধাবী সন্তানদের বঞ্চিত করছে, অন্যদিকে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সরকারী হিসাব মতে,বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি পরীক্ষায় সর্বপ্রথম ১৯৭৯ সালে মাধ্যমিক বা এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা তীব্রতা লাভ করে আরো পরে। ২০১৪ সাল থেকে পিএসসি, জেএসসি, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মতো বাংলাদেশের অন্যান্য সরকারি পরীক্ষারও প্রশ্ন ফাঁস শুরু হয়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ একাধিকবার এসেছে।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সব কয়টি সরকারি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে একাধিক রিপোর্ট পাওয়া গেলেও সরকার কর্তৃক বরাবরই এই দাবি নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এর কিছুদিন পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রশ্ন ফাঁসে দোষীদের পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িতদের শিগগিরই চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্তব্য করেন।২০১৪ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ঢাকা বোর্ডের ইংরেজি প্রশ্ন ফাঁস হলে পরীক্ষাটির তারিখ পরিবর্তন করা হলেও, অন্যান্য পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পরেও এ ধরনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে সরকার থেকেও একেক সময় একে ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায়। কখনো এই দাবি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়। আবার কখনো আগের চেয়ে কম হারে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বলে মন্তব্য করা হয়।এছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদেরকেও প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত বলে মন্তব্য করেছিলেন। এতদিন পরে শিক্ষা মন্ত্রীর কথা বাস্তবে প্রমানিত হলো।
প্রশ্ন যেন ফাঁস না হয় সে জন্য অনেক রকম উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। প্রশ্ন ফাঁস হয়েই যাচ্ছে। সব দেখেশুনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে। মন্ত্রী এবং সচিব- সবার কণ্ঠেই হাল ছেড়ে দেয়ার সুর। সবাই অসহায় আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন। ভাবটা এমন, যা হয় হোক, আমাদের আর কিছু করার নেই। এক প্রশ্ন ফাঁসের ব্যর্থতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব সাফল্য চাপা পড়ে গেছে।
এবার এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে মন্ত্রণালয় অনেক সিরিয়াস ছিল। পরীক্ষা শুরুর আগেই কোচিং সেন্টার বন্ধ, কেন্দ্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, এমনকি কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে কারো হাতে মোবাইল পেলে তাকে গ্রেপ্তার করা, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে এমনকি ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও হয়েছিল, যদিও পরে তা আর কার্যকর হয়নি। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পুলিশও কিছু এলোমেলো ধরপাকড় করেছে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি হাইকোর্টে গেছে। রিট হয়েছে, হাইকোর্ট রুল দিয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এই সব করতে করতে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হচ্ছে না।
ছেলেবেলায় কাজের সংজ্ঞায় পড়েছিলাম, সারাদিন যদি কেউ একটি পাথর ঠেলে, কিন্তু একটুও সরাতে না পারে; তবে সেটা কাজ হিসেবে গণ্য হবে না। প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সকল উদ্যোগ, সকল চেষ্টাও শেষ পর্যন্ত সেই সংজ্ঞায় অকাজ হয়ে যায়।
প্রশ্ন ফাঁস যদি বন্ধ না হয়, আপনার সকল চেষ্টাই আসলে অর্থহীন। ব্যাপারটা এখন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্রশ্ন ফাঁস চক্র যেন সরকারের সাথে চোর-পুলিশ খেলছে। এখন আর অর্থনৈতিক লাভের জন্য কেউ প্রশ্ন ফাঁস করে বলে মনে হয় না। প্রশ্ন ফাঁস এখন কারো কারো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এখন সরকারকে বিব্রত করার জন্যই করা হচ্ছে বলে মনে হয়।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনৈতিকতার শেকড় এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে, কোচিংবাজ, প্রাইভেটবাজ শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক কাউকে সেখান থেকে আলাদা করা কঠিন। তাই নীতিকথায় কাজ হবে না। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে চাই কঠোর আইনী ব্যবস্থা। এখানেই লুকিয়ে আছে, প্রশ্ন ফাঁস রহস্যের সমাধান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর আন্তরিক চেষ্টাই পারে এ সমস্যার সমাধান করতে। এখানে মিষ্টি কথায় কাজ হবে না। মিথ্যা বলা মহাপাপ, এটা জেনেও তো অনেকে মিথ্যা বলেন। কিন্তু মিথ্যা বললে পুলিশ ধরবে, এটা জানলে অনেকে সাবধান হবেন। প্রশ্ন ফাঁস করা করা একটি পাপ কাজ এটা বলে কোনো লাভ নেই। প্রশ্ন ফাঁস করলে পুলিশ ধরবে, এটা জানলেই শুধু সাবধান হবে মানুষ। তাই র্যাব-পুলিশের কঠোর ও আন্তরিক উদ্যোগই কেবল পারে, প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতে। এখন যেভাবে পুলিশ এলোমেলো অভিযান চালাচ্ছে, সবচেয়ে সহজ শিকার হিসেবে শিক্ষার্থীদের ধরছে, তাতে কোনো কাজ হবে না।
বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ মোকাবেলায়ও র্যাব-পুলিশের ভূমিকা প্রশংসিত। তাই পুলিশকে সত্যিকার অর্থেই ‘জিরো টলারেন্স’ নিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে মাঠে নামার নির্দেশনা দিতে হবে।
প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো কঠিন তবে অসম্ভব নয়। আমি এখনও বিশ্বাস করি, সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিক উদ্যোগই পারে এই ভয়াবহ বিষ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে। নইলে ভবিষ্যত অন্ধকার। কারণ শিক্ষাই যে জাতির ভবিষ্যত। সমাজ ও রাষ্ট্রকে এই দুষ্টচক্রের হাত থেকে বাঁচাতে হবে যে কোনো উপায়ে। মানুষের নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও মানসিকতা উন্নত করতে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বয়কট করতে হবে সামাজিকভাবে।
এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, অর্থের লোভে উচ্চশিক্ষিত মানুষও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি এখন মহাদুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে গভীরভাবে।