প্রশাসনে দক্ষতা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে বাস্তবসম্মত পলিসি প্রণয়ন করা হবে। একই সঙ্গে কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বিভিন্ন ধাপে প্রশিক্ষক ও বিশেষজ্ঞ বক্তা তৈরির মতো সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন পেশায় দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিদেরও আউটসোর্সিং করে আমন্ত্রিত বক্তার তালিকা অনুমোদন দেওয়া হবে।
ইতোমধ্যে প্রাথমিক কাজও শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রধান উদ্দেশ্য-পলিসি প্রণয়নে গবেষণাধর্মী কাজ এবং অভিজ্ঞতা আদান-প্রদান করা। পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, প্রশাসনের সামনে নানামুখী বিভিন্ন সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে মূলত প্রধান তিনটি সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। প্রথমত, উচ্চশিক্ষিত কর্মকর্তার কোনো ঘাটতি না থাকলেও প্রবলভাবে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ যেসব স্থানে যে ধরনের দক্ষ লোক প্রয়োজন, তা নেই। দ্বিতীয়ত, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শিক্ষাজীবনে যা শিখে এসেছেন, এর বেশির ভাগ কর্মজীবনে আসে কাজে লাগছে না।
এর বাইরে তৃতীয়ত আরও একটি বিষয় ইদানীং প্রবল ঘাটতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেটি হলো-কর্মস্থলে বিভিন্ন ধরনের সেবাপ্রার্থী ফেস করা ছাড়াও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কীভাবে মানুষের সঙ্গে আচরণ করতে হবে, একজন কর্মকর্তা কী বলতে পারেন, কতটুকু বলতে পারেন, তার সঙ্গে কী কী আচরণ যায়, এমনকি তিনি কোন স্থানে কী ধরনের পোশাক পরবেন-সেসব বিষয়েও অনেকের মধ্যে ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে একজন কর্মকর্তা যখন গুরুত্বপূর্ণ পদ বা দায়িত্ব পালন করেন, তখন তিনি আর নিজের থাকেন না। তিনি হয়ে যান, সমাজ, রাষ্ট্র এবং জনগণের। অর্থাৎ ব্যক্তি থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠান হিসাবে আবিষ্কার করা। সমাজের বিভিন্ন পেশার সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ ধরনের ব্যক্তিরা চাইলেই যা ইচ্ছা তাই বলতে কিংবা করতে পারেন না। অথচ ডিসি এবং ইউএনওর মতো অফিসিয়াল সেলিব্রেটিদের কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে সাম্প্রতিক সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করেছেন। যা শুধু অসদাচরণ নয়, তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড গোটা প্রশাসনকে বিব্রত করছে। ফলে এটা বলা যায়, চাকরিজীবনের শুরু থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তাদের যেসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তা হয় যথেষ্ট নয়, অথবা দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতা শেখাতে নতুন করে প্রশিক্ষণ কারিকুলাম চালু করতে হবে। সূত্রগুলো বলছে, এ ধরনের বাস্তব কিছু সমস্যা ও প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে নীতিনির্ধারকরা প্রশাসনের সামনে নতুন মিশন ও ভিশন দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, উল্লেখযোগ্য এ তিনটি সমস্যা সমাধানে প্রথম পর্যায়ে চারটি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এগুলো হলো-রিসোর্স পার্সন পুল গঠন, প্রশিক্ষণ পুল নীতিমালা প্রণয়ন, উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কোর্স চালু এবং পলিসি প্রণয়নে খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও প্রশিক্ষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সহিদুল্ল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। যিটি সফলভাবে করতে সক্ষম হয়েছে জাপান ও সিঙ্গাপুরসহ আরও কয়েকটি দেশ। তাদের অন্য কোনো সম্পদ তেমন নেই। তারা শুধু মানবসম্পদকে দক্ষ করেই উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে।’ তিনি বলেন, এজন্য আমরা সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি দক্ষ জনবল তৈরির ওপর। এক্ষেত্রে সফল হলে আমাদের উন্নয়নের গুণগত মান যেমন বাড়বে, তেমনই আমরা আরও উন্নত জাতিতে পরিণত হতে পারব। বিশেষ করে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিপুলসংখ্যক দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠানো সম্ভব হবে। এর ফলে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব।
রিসোর্স পার্সন পুল : এ উদ্যোগের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে। পুলের জন্য নির্বাচিত হওয়া ১০০ কর্মকর্তাকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হবে। আপাতত প্রশাসন ক্যাডার থেকে নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত নিয়মকানুন জানিয়ে শিগগিরই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ক্যাডার থেকেও নেওয়া হবে। হার্ভার্ড ১৬৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষা মানের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্ধারিত বিষয়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশেষভাবে দক্ষ করা হবে।
প্রশিক্ষণ পুল নীতিমালা : এই পুলের নীতিমালায় জুনিয়র ক্যাটাগরিতে উপসচিব পর্যন্ত একটি স্তর এবং উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ে আরও একটি স্তর থাকবে। এর বাইরে থাকবেন গ্রেড-১-এ থাকা কর্মকর্তা। এছাড়া সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে খ্যাতি অর্জনকারী বিশেষ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এই পুলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একজন কর্মকর্তা তার পারদর্শিতার মধ্যে তিনটি বিষয়ে অপশন দিতে পারবেন। বিষয়গুলোর ওপর প্রেজেনটেশনও দিতে হবে। সেখান থেকে অধিকতর যোগ্যদের বাছাই করে প্রশিক্ষণ তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।
এছাড়া উপসচিব ও যুগ্মসচিব পর্যায়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হচ্ছে। যারা গণমাধ্যম ফেস করাসহ বিশেষ কিছু বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় প্রশিক্ষণ কাউন্সিলের পরবর্তী সভায় এ বিষয়সহ আরও কয়েকটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে।
উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কোর্স : সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কাজের বিষয়ে দক্ষ কর্মকর্তা তৈরি করতে দেশে ৩ মাস এবং বিদেশে ১ মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রতিটি প্রশিক্ষণের শুরুতে মোটিভেশনাল পর্ব থাকবে। যেখানে দেশের বিখ্যাত আইকনরা বক্তব্য দেবেন। কর্মকর্তারা যাতে সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন, সেসব বিষয় নিয়েও সেখানে আলোচনা হবে। তবে এ প্রশিক্ষণের সবচেয়ে বড় দিক হলো কর্মকর্তারা যাতে অবকাঠামোগত সব ধরনের কারিগরি কাজের ত্রুটি ধরতে পারেন, সে বিষয়ে তাদের দক্ষ করে তোলা। এর ফলে কোনো ঠিকাদার রড, সিমেন্ট কিংবা কার্পেটিংয়ের কাজে ফাঁকি দিলে প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তারাও টেকনিক্যালি সহজে তা চিহ্নিত করতে পারবেন।
সমঝোতা স্মারক চুক্তি : ভবিষ্যতে প্রশাসন সংস্কারে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা, আইন ও বিধিমালা তৈরির ক্ষেত্রে আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা চালানো হবে। এজন্য যুক্ত করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষকদের। যাতে পর্যাপ্ত ও বাস্তবভিত্তিক গবেষণার ফলে সবকিছু যথাযথভাবে কার্যকর করা যায়। মন্ত্রণালয় ও বিভাগভিত্তিক কাজের বিপরীতে দক্ষতার চাহিদা প্রস্তুত করা হবে। এজন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে জানতে চাওয়া হবে, কোন কোন বিষয়ে কী ধরনের দক্ষ কর্মকর্তা প্রয়োজন। এরপর সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বিদ্যমান সব কারিকুলাম নতুন করে ঢেলে সাজানো হবে। এছাড়া ছাত্রজীবন থেকে এ ধরনের দক্ষ লোক তৈরি করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও চিঠি দেওয়া হবে। যাতে বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের সিলেবাসে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারে। সার্বিক বিষয়ে ৩০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে স্বাক্ষর করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজম।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিষয় আছে; কিন্তু ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয় নেই। অথচ যত সমস্যা ভূমি নিয়ে। মাঠপর্যায়ের ভূমি অফিস থেকে শুরু করে আদালতপাড়ায় বিস্তর মামলা ভূমি নিয়ে। ফলে মাঠের বিদ্যমান সমস্যার আলোকে এ বিষয়ে আমাদের অনার্স ও মাস্টার্সে পড়াতে হবে। অপরদিকে এখন তো সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হলো ডিজিটাল মার্কেটিং এবং আইটিসংক্রান্ত একাধিক বিষয়। সেজন্য এসব বিষয় সমন্বয় করে নতুনভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনার্স ও মাস্টার্স খোলা দরকার।
তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোয় ছোটবেলা থেকে ধাপে ধাপে শিক্ষার্থীদের মেধাকে ফিল্টার করে তার ভবিষ্যৎ গড়ার বিষয় ও কর্মজীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। যাদের মেধা একটু কম কিংবা যাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই, দ্রুত আয়-রোজগারে যেতে হবে, তাদের পাঠানো হয় ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ে। বাকি মেধাবীদের দিয়ে উচ্চশিক্ষাসহ গবেষণার কাজ করানো হয়।
অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণলব্ধ বেশির ভাগ জ্ঞান কাজে লাগে না। দেশে ফিরে যে থিসিস পেপার জমা দেওয়া হয়, তা অনেকাংশে একটা কাগুজে পেপার ছাড়া আর কিছু নয়। বেশির ভাগ কর্মকর্তা ওই প্রশিক্ষণে সেভাবে মনোনিবেশ করেন না। এছাড়া দেশে আসার পর কাজে প্রয়োগ করার সুযোগ থাকে না অনেকের। শুধু কর্মকর্তার পিডিএস-এ শোভা পায়।
তিনি জানান, আমাদের প্রশিক্ষণের ট্রেডগুলো সব পুরোনো। এখন বেশি করে দরকার আইটি সেক্টর ও ডিজিটাল মার্কেটিং সংক্রান্ত পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ। এছাড়া বাস্তবভিত্তিক আরও অনেক নতুন কাজ সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য বাস্তব কাজের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের কী ধরনের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে, তা চিহ্নিত করে দেশ ও বিদেশের প্রশিক্ষণ সিলেবাস পরিবর্তন করা হচ্ছে। দক্ষতার ঘাটতিগুলো জানতে শিগগির প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর তৈরি হবে প্রশিক্ষণের নতুন সিলেবাস বা বিষয়।