২৭ কার্তিক (১২ নভেম্বর) :মোঃ হায়দার আলী, রাজশাহী:

একটা সময় এ দেশের মানুষকে বলা হতো মাছে-ভাতে বাঙালি। সে সময় গ্রামাঞ্চলোর জলাশয়গুলোতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। বাড়িতে যদি ভাত নাও থাকত, তবুও মাছের কমতি ছিল না। অনেকের এমনও দিন গেছে যে, ভাত না খেয়ে শুধু মাছ খেয়ে থাকতে হয়েছে তাদের। মৎস্য আহরণ ছিল সহজ ব্যাপার। সেই সময় প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। আজ আমরা এসব মাছ খুব বেশি দেখতে পাই না। যদিও কালেভদ্রে দেখা যায়, সেগুলোর অধিকাংশই বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। ফলে দেশি মাছের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না।
নদী মাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিল-নালা, পুকুর ডোবা,  হাওর-বাঁওড়, ধানক্ষেত, পানিবদ্ধ বিলগুলো হচ্ছে- দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রধানতম উৎস। এসব উৎস ধ্বংস, অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার এবং নানাভাবে পরিবেশ দূষণের ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। ট্যাংরা, টাকি, চান্দা, মহাশোল, সরপুঁটি, টাটকিনি, বাগাড়, রিটা, পাঙাশ আর চিতল এসব মিঠা পানির মাছের প্রজাতিগুলো চরম হুমকিতে রয়েছে। গত কয়েক দশকে বেশ কয়েক প্রজাতির পরিচিত দেশীয় মাছ এখন আর বাজারে দেখা যায় না। বর্তমানে দেশের ১১৮ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে বিলুপ্ত প্রায় মিঠা পানির মাছের প্রজাতির সংখ্যা ৬৪টি।
গত কয়েক দশক ধরে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয়গুলোর আয়তনে সংকোচন, নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবার পানির অপরিমিত ব্যবহার, ডোবা-নালা ভরাট করা, কৃষিকাজে ব্যবহৃত কীটনাশকে পানির দূষণ এবং অপরিকল্পিতভাবে নিষিদ্ধ কারেন্ট জালে মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরার ফলে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের সংখ্যা অনেক কমছে। গত কয়েক বছরে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
 বর্তমান প্রজন্ম আজ অনেক দেশি জাতের মাছের কথা ভুলে গেছে। তাদের সঙ্গে যখন দেশি মাছের কথা আলোচনা করা হয়, তখন তারা এমন ভাব করে যেন নামগুলো এই প্রথম শুনছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে এই মাছগুলো বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে? আসলে এই মাছগুলো এমনি এমনি বিলুপ্ত হচ্ছে না, বরং বিলুপ্ত করা হচ্ছে। আজ আমরা অধিক ফলনের আশায় জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করছি। এসব কীটনাশক বৃষ্টির পানির মাধ্যমে খাল ও বিলে গিয়ে পৌঁছায়। এর ফলে ওইসব খাল-বিলের মাছ মরে যায়। অন্যদিকে অনেক মাছ ডিম ফুটে বাচ্চা বের করার সময় আহরণ করা হচ্ছে। এর ফলে ওই মাছগুলো ডিমসহ ধরা পড়ছে। এভাবে মাছ ধরার কারণে অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে অতি মাত্রায় পোনা মাছ আহরণ করা হয়, যার ফলে ওই মাছগুলো নিশ্চিত বিলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছে। তাই মানুষকে এভাবে মাছ আহরণ থেকে বিরত রাখতে হবে।
বাংলাদেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে ১০০র বেশি দেশীয় মাছ থাকলেও এখনো কোন মাছকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়নি আইইউসিএনের এ সংক্রান্ত নিয়মটি হচ্ছে, সর্বশেষ কোন একটি প্রজাতির মাছের দেখা পাবার পর পরবর্তী ২৫ বছরে যদি সেই প্রজাতির অস্তিত্বের কোন প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে সেটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলাসহ উত্তরাঞ্চলের খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় থেকে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ দেশিয় বিভিন্ন প্রজাতির ছোট ছোট মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এর কারন হিসেবে জানা গেছে, প্রাকৃতিক ও একশ্রেণির অসৎ মানুষের যত্রতত্র করেন্ট জাল ব্যবহার করায় এ জাতীয় দেশী অনেক মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। আইন থাকলেও এর বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
 প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জলাভূমির সঙ্গে সংযোগ খাল ভরাট, জলাশয়ে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া। এ ছাড়া
 একশ্রেণির মানুষ অপরিকল্পিতভাবে মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যবহার করে মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করায় দেশিয় বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-ছোট মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বিলুপ্তির শঙ্কায় থাকা এসব মাছের মধ্যে রয়েছে- চ্যাপিলা, বইচা, আইড়, পুঁটি, সরপুঁটি, বাইলা, মেনি, শিং, মাগুর, শোল, কই, টাকি প্রভূতি।
একসময় খাল, বিল, জলাশয়ে  প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। বাজারগুলোও ভরে যেত দেশিয় বিভিন্ন ধরণের মাছে। বর্তমানে চায়না প্রযুক্তির কারেন্ট জালের পর রিংজাল ব্যবহার করায় ওই জাতীয় ছোট মাছের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। ফলে বাজারে ছোট প্রজাতির মাছের সরবরাহ অনেকটা হ্রাস পেয়েছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী, রেলওয়ে বাজার, হাটপাড়া, সুলতানগঞ্জ, রেলগেট, কদম হাজিরমোড়, পিরিজপুর, কাঁকনহাট, বাসুদেবপুর, বিলপাতিকলা, দূর্গাদহ বিল, রাজাবাড়ীর খাল, বিল, পদ্মা, মাহনন্দা নদী ও জলায়শের ছোট মাছ ধরার জন্য কারেন্ট জাল বা রিংজালের ব্যবহারে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে একশ্রেণির মৎস্য শিকারিদের মধ্যে।
 খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ওইসব উপজেলার বিভিন্ন স্থানে চায়না রিংজাল নদ-নদী, খাল-বিল জুড়ে ফাঁদ পেতে রাখা হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক সবধরনের দেশিয় মাছ ধরা পড়ছে চায়না প্রযুক্তির রিংজালে। এক শ্রেণীর অসৎ মৎস্যজীবিগণ নদী, খাল, বিল, বড়, বড় পুকুর, জলাজয়ে ভারতীয় বিষ প্রয়োগ করে মাছের বংশ শুধু বিলুপ্ত করছেন না। এসব বিষ মিশ্রিত মাছ খেয়ে নানা মানুষ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
রাজশাহীর একজন  হৃদরোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, আকারে ছোট হলেও এসব দেশিয় মাছ পুষ্টিগুণে সেরা। তাই এসব মাছ বিলুপ্তির কারণে পুষ্টির বড় উৎস্য হারিয়ে যাচ্ছে। খাল, বিল, জলাশয়ে মূলত ছোট মাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে। জমিতে রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে এবং কারেন্ট জাল বা রিংজাল ব্যবহার করায় প্রোটিন ছাড়াও ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়োডিন ও ভিটামিনযুক্ত এসব মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
 গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জানে আলম আইন শৃঙ্খলা সভায় আতঙ্কিত হয়ে বলেন, পদ্মায় বিষ দিয়ে একশ্রেনীর মানুষ  মাছ আহরণ করছেন। এ মাছ খেয়ে মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে তিনি জানান।