ভোট পেরোনোর পর সপ্তাহ না ঘুরতে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, নানা অজুহাতে মিলাররা বেশি দামে চাল বিক্রি করায় পাইকারি পর্যায়ে গত এক সপ্তাহে চালের দাম বেশখানিকটা বেড়েছে। যার প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সদ্য শেষ হওয়া বছরে আমন ধানের রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। তবে নির্বাচন শেষ হতেই বাজার সিন্ডিকেট ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের কারসাজিতেই চালের দাম বেড়েছে। এদিকে শুধু চালই নয়, বাজারে আটা ও ময়দার দামও এখন ঊর্ধ্বমুখী।
প্যাকেটজাত আটা ও ময়দার দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে। গতকাল বাজারে প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৬৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এই দাম ছিল কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ভোক্তারা জানিয়েছেন, ডাল ও ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল থাকলেও মাছ-মাংসের সঙ্গে এবার সবজির দামও চড়তে শুরু করেছে। ভোটের পর মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। আর গরুর মাংসের দাম এক লাফে ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায় ছুঁয়েছে। সাধারণত শীত মৌসুমে ২০-২৫ টাকা দরে আলু বিক্রি হলেও এখন ৬০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
সদ্য শেষ হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হঠাৎ করে চালের দাম বাড়া নিয়ে বাজার পর্যবেক্ষকরা নানা যুক্তি তুলে ধরেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনের পর চার কারণে বেড়েছে চালের দাম। এগুলো হচ্ছে- সরবরাহে সমস্যা, ধানের দাম বাড়া, খুচরা পর্যায়ে মনিটরিং না করা ও অসাধু সিন্ডিকেটের কারসাজি।
তাদের ভাষ্য, নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষ থেকে বাজারে কঠোর তদারকি থাকায় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে পারেননি। ফলে নির্বাচনের পর তদারকিতে ঘাটতির সুযোগ বুঝে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে অসাধু সিন্ডিকেট। তাদের কারসাজির কারণে আমনের বাম্পার ফলনের পরও চালের দাম বেড়েছে।
এদিকে ভোটের পরপরই নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অগ্রাধিকারভিত্তিক ১১টি বিষয়ের প্রথমটি ছিল দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এছাড়া দলের শীর্ষ নেতারা সাধারণ মানুষের কাছে ভোট চাইতে গিয়ে দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করার অঙ্গীকার করেছেন। মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া ও চাঁদাবাজি বন্ধ করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে ভোটের লড়াই শেষ হতেই ৫-৭ দিনের ব্যবধানে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন হতাশা ভর করেছে।
অন্যদিকে আসন্ন পবিত্র রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবনিযুক্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা উল্টো ‘বুমেরাং’ হবে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকেই। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, রমজানে তদারকি বাড়বে এ সম্ভাবনা মাথায় রেখে গত কয়েক বছরের মতো এবারও মুনাফাখোর মজুতদার ও বাজার সিন্ডিকেট ইফতারিতে প্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম আগেভাগেই বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া অবৈধ মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিরও আশঙ্কা করছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা।
এ প্রসঙ্গে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, প্রতি বছরই রোজা শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে বিভিন্ন অজুহাতে ছোলা-খেজুরসহ রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা, যাতে রোজার সময় প্রশাসনের চাপে বাধ্য হয়ে কমিয়ে দিলেও আশানুরূপ লাভ থাকে।
তার এ আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা গত কয়েক দিনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে নিশ্চিত হওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রমজান আসতে এখনো মাস দুয়েক বাকি থাকলেও এরই মধ্যে ওই সময়ের চাহিদাসম্পন্ন নিত্যপণ্য ছোলা, মুড়ি, ডাল, বেসন, খেজুরসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছোলা খুচরায় কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা এবং ছোলার ডাল, খেসারির ডাল, মুগ ডাল ও বেসনের দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে জাতভেদে সব ধরনের খেজুরের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। যদিও আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, এলসি জটিলতাসহ নানা কারণে আমদানি ব্যয় বেশি। এতে আমদানি করা এসব পণ্যের দাম বাড়াতে তারা বাধ্য হয়েছেন।
যদিও বাজার পর্যবেক্ষকরা তাদের এ দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের ভাষ্য, প্রতি বছর রমজান এলেই বাজার সিন্ডিকেট নানা ধরনের কারসাজির মাধ্যমে নিত্যপণ্যের মূল্য অস্থিতিশীল করে তোলেন। যার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালি মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি জরুরি।
বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডলার সংকট, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন কম ইত্যাদি অজুহাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মুষ্টিমেয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। নানা কায়দায় সিন্ডিকেট গড়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় তারা। ভোক্তারা বাড়তি দামের চাপে পড়লেও সরকারের মন্ত্রী-সচিবরা বরাবরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সিন্ডিকেটের ব্যাপারে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
অর্থনীতিবিদ ও ভোক্তা অধিকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সিন্ডিকেট প্রতিরোধ করতে হবে। কারা সিন্ডিকেটে জড়িত, তা সরকারের নীতিনির্ধারকরাও জানেন। তবে সিন্ডিকেটে জড়িতদের হাত এতই লম্বা যে, তা ভাঙা দুরূহ। রাজনীতির ঊর্ধ্বে এসে ব্যবস্থা না নিলে সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়। তবে রাষ্ট্র চাইলে যে কোনো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে। তবে কারা ওই সিন্ডিকেটে জড়িত, তা থেকে যায় আড়ালে। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, সিন্ডিকেটের হোতারা মূলত করপোরেট হাউজের মালিক। আর এসব কোম্পানির মালিকরা সবাই কমবেশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে নানা সময়ে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে বাজারে কারসাজির অভিযোগ উঠলেও দৃশ্যত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ৫০ বছরে দেশে চালের উৎপাদন চার গুণ বেড়েছে। তবুও স্থির নয় চালের বাজার। ভরা মৌসুমেও ভোক্তাদের চালের দামে নাকাল হতে হয়। যার সবসময়ই সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই সংঘটিত হচ্ছে।
চাল ব্যবসায়ীরা জানান, পণ্যটির ব্যবসায় কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও মৌসুমি ব্যবসায়ী ঢুকে পড়েছে। তারা ধান কিনে চাল মজুত করে এবং চাহিদা বাড়লে বাড়তি দামে তা বিক্রি করে। এতে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের হাতে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি.) এক গবেষণায় বলা হয়, করপোরেট প্রতিষ্ঠান চালের বাজারে ঢুকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ধান-চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে পাঁচবার তা হাতবদল হয়। প্রতিবার হাতবদলের সময় যোগ হয় খরচ ও মুনাফা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেন চালকল মালিকরা। তারা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে ৮ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেন।
অথচ এ সিন্ডিকেট ভাঙতে দীর্ঘদিনেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের তদারকি প্রতিষ্ঠান চালের বাজার কারসাজিতে জড়িতদের পরিচয় জেনেও নিশ্চুপ থাকছে। ফলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপণ্যের ব্যবসা মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে। এরা অলিগোপলি বাজার সৃষ্টি করে রাখে। একজন দাম বাড়ালে অন্যরা তা অনুসরণ করে। তারা ঝোপ বুঝে কোপ মারে। এভাবে ভোক্তার পকেট কাটা হচ্ছে বছরের পর বছর। প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বাজার সিন্ডিকেটের এমন কারসাজি।
তিনি আরও বলেন, দাম যে শুধু বড়রা বাড়ায়, তা নয়। সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীর মধ্যে অতি মুনাফার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। খুচরা থেকে উৎপাদনকারী- সবাই এখন সুযোগসন্ধানী। এ ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণে দুর্বলতা লক্ষণীয়।
এদিকে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সিন্ডিকেট চক্রকে কোনোভাবে রোখা যায় না বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, যারা বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট করছেন, তারা রাজনীতিতেও সক্রিয়। কারা সিন্ডিকেশনের সঙ্গে জড়িত, তা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরাও জানেন। তাই রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনা হয় না।
তিনি আরও বলেন, শর্ষের ভেতরে ভূত আছে। সেই ভূত না তাড়ালে সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ জেল-জরিমানা ছাড়াও সামাজিকভাবে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তার মতে, প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা না গেলে বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা কমিশন নখদন্তহীন। এ কারণে সিন্ডিকেট তাদের তোয়াক্কা করে না।
এদিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য ঢালাওভাবে সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হলেও এর নেপথ্যে আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে। অথচ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কখনই এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নির্বাচন পেরোতেই চাল-আটা-ময়দাসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজির পাশাপাশি পণ্য পরিবহণ ও লেনদেনে নতুন চাঁদাবাজ গ্রুপের তৎপরতাকেও দায়ী করেন তারা। পণ্য পরিবহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, ভোটের লড়াই শেষ হতেই সারাদেশে সড়ক পরিবহণে পথে পথে চাঁদাবাজির তাণ্ডব পণ্য পরিবহণে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পরিবহণের চাঁদা নিয়ে সারাদেশে গড়ে ওঠা পুরনো চাঁদাবাজ চক্রের পাশাপাশি নতুন করে আরও একটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় বিগত টার্মের সাংসদকে পরাজিত করে নতুন কেউ নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানে তার সহযোগীরাও চাঁদার টিকিট লাগিয়েছেন। ফলে পরিবহণ খরচ নতুন করে বেড়েছে। যা পণ্যের দামের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।