তীব্র আকার ধারণ করেছে দেশের গ্যাস সংকট পরিস্থিতি। প্রায় দুই মাস ধরে চাহিদার বিপরীতে এর জোগান নেমেছে প্রায় অর্ধেকে। বিশেষ করে শিল্প খাতের এই সংকট আরও ভয়াবহ। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিসেম্বরের শুরু থেকেই অঞ্চলভেদে গ্যাসের সরবরাহ কমে ৩০-৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই অবস্থা আবাসিক ও পরিবহণ খাতেও।
বছরজুড়েই গ্যাসের সংকট থাকলে গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তা আরও অবনতি হয়েছে। খোদ জ্বালানি বিভাগের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে চাহিদার মাত্র ৬২ শতাংশের জোগান দিতে পারছেন তারা। তবে বাস্তবে এই ঘাটতি আরও বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মূলত রুটিন সংস্কারের জন্য দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি গত ৩ মাস ধরে বন্ধ থাকায় এই সংকট শুরু হয়। জ্বালানি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪১০ কোটি ঘনফুটের মত, এর বিপরীতে স্বাভাবিক গড় সরবরাহ সাড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় প্রায় ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। ফলে মোট সরবরাহ নেমেছে ২৫৫ কোটি ঘনফুটে।
যদিও মোট গ্যাসের প্রায় ৫০ শতাংশই ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। কিন্তু গত ২-৩ মাস ধরে বিদ্যুতের চাহিদা একতৃতীয় অংশ কমে যাওয়ায় এই খাতে গ্যাসের ব্যবহার কমছে। তবে এ বছর নতুন বেশ কয়েকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু ও সার কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোতে সরবরাহ ঘাটতি বেড়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টার্মিনাল বন্ধ থাকতেই পারে। সে ক্ষেত্রে এর বিকল্প নির্ধারণ করে বন্ধ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও নির্বাচন নিয়ে সরকারের ব্যস্ততার কারণে পুরো বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পায়নি বলে মনে করছেন অনেকেই।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লা বলেন, এখন জ্বালানি বিভাগ নড়েচড়ে বসলেও এটা নিয়ে যে তাদের তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না, তা স্পষ্ট। যেহেতু শীতে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের ব্যবহার কম; হয়ত এই সুযোগে টার্মিনাল সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ শুরু হওয়ায় মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মত তার।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খানও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় সরবরাহ ঘাটতি হচ্ছে, যেহেতু শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কম, তাই এটা তেমন সমস্যা নয়। মূলত সার কারখানায় গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাস সরবরাহের কারণে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। কিন্তু সংকট দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্সের দুই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার তিনটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষামূলকভাবে চালুর জন্য গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে এলে গ্যাসের ঘাটতি আরও বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আমদানিকৃত এলএনজি ব্যবহার করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চুক্তিতেই অনুমোদন পায় এই কেন্দ্রগুলো।
অন্যদিকে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না পেয়ে উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার করতে পারছে না অধিকাংশ শিল্প-কারখানা। এই খাতের উদ্যোক্তরা জানান, এমনিতেই চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি থাকে শিল্প-কারখানায়, যা এখন ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হলেও কোনো সমাধান হয়নি।
এদিকে গ্যাসের সংকট সমাধানের দাবি তুলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল পোশাক খাতের নিটওয়্যার শিল্পোদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএ। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরেই এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দাবি জানানো হচ্ছে, কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি।
সংকট তীব্রতা পেয়েছে আবাসিক ও পরিবহণ খাতেও। দিনের সিংহভাগ সময় চুলা জ্বলছে না রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আবাসিক এলাকায়। অন্যদিকে গ্যাসের অপেক্ষায় থাকা যানবাহনের লাইন প্রতিদিনই বাড়ছে। পরিবহণ-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নভেম্বর থেকে গড়ে অন্তত ২-৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় সিএনজি স্টেশনগুলোতে।
পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মহেশখালীর এক্সিলারেট এনার্জির এই ভাসমান টার্মিনালটির (এফএসআরইউ) সংস্কার কাজ শেষ হলেই সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, দুই-এক দিনের মধ্যেই টার্মিনালটি চালু করা হবে। এতে কিছুটা হলেও সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
তিনি বলেন, গ্যাস আমাদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই অসুবিধা খুব সাময়িক। শীতের কারণেও গ্যাসের চাপ কিছুটা কমে যায়। তবে আগামী মার্চ থেকে গ্যাসের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ভোলা থেকে সিএনজি গ্যাস আনার প্রক্রিয়া মার্চে শুরু করা হবে বলেও জানান তিনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৪৬টি কূপ ২০২৫ সালের মধ্যে খনন করা হবে। এতে এই সময়ের মধ্যে দেশে ৫০০ এসএফটি গ্যাস সরবরাহ বাড়বে। এ ছাড়াও পেট্রোবাংলা ৫০ বছরের গ্যাস উত্তোলন, সরবরাহ-সংক্রান্ত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।