প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে আর দুমাস। ভৌত অগ্রগতি ২৪ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অগ্রগতি বলতে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ও যানবাহন ব্যবহার বাবদ খরচ মুখ্য। অনুমোদনের প্রায় পাঁচ বছরে এ অগ্রগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে অর্থায়নকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক। অর্থছাড় করতেও অস্বীকৃতি জানায়।

এ অবস্থায় মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করলে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পরিবর্তনসহ বিভিন্ন শর্ত দেয় বিশ্বব্যাংক। এসব শর্ত পূরণ করায় পুনরায় ঋণের অর্থ দিতে রাজি হয়েছে সংস্থাটি। মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টিতে সম্মতি জানালেও আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত হয়নি। প্রকল্প সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

রাজধানীর মানুষের নাগরিক সুবিধা বাড়াতে নেওয়া ‘ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডিং প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রকল্পে এ ঘটনা ঘটে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় ২০১৯ সালের ১ মার্চ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনুমোদিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুযায়ী প্রকল্পটি ৩০ জুন ২০২৪-এ শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পটি অদক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার কারণে অগ্রগতি অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় দায়ী সাবেক প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে বিশ্বব্যাংক। পরে বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণে প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করা হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীসময়ে তার পরিবর্তে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল) রাজিব খাদেমকে। প্রকল্পের সব জনবল এবং সেটআপও পরিবর্তন করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের শর্তে। এটা না করলে ঋণও বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। সব শর্ত পূরণ করায় ঋণ দিতে রাজি হয়েছে সংস্থাটি।

আরও পড়ুন

মেয়াদ বাড়ছে না ৩৩০ প্রকল্পের, শেষ করতে হবে জুনের মধ্যে
‘দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে বে-টার্মিনালে’
অভিযোগ পেলে পিডিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, প্রয়োজনে পরিবর্তন
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ায় সংস্থাটি ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী প্রকল্প পরিচালক ও লোকবল পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রকল্পের নকশা, মোট ব্যয়েও পরিবর্তন আনা হয়। সব শর্ত পূরণ করার ফলেই প্রকল্পে ঋণ দিতে রাজি হয় বিশ্বব্যাংক।

প্রকল্পটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বাস্তবায়ন করছে। ডিএসসিসি জানায়, প্রকল্পের আওতায় মোট ২১টি ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ রয়েছে, যার মধ্যে একটির কাজ সমাপ্ত। ১৩টি প্যাকেজের কাজ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নাধীন। একটি প্যাকেজের কাজ (আংশিক) চূড়ান্ত করে বাতিল করা হয়েছে। দুটির দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান এবং চারটি প্যাকেজের প্রস্তুতি চলমান। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ২৪ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ অর্থায়ন বিশ্বব্যাংকের।

প্রকল্পের ডিপিপি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে মেয়াদ বাড়াতেই হবে। মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। মেয়াদ একবছর বাড়ানোর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সম্মতি পাওয়া গেছে। তবে এখনো বাড়ানো হয়নি।- প্রকল্প পরিচালক রাজীব খাদেম

নতুন প্রকল্প পরিচালক রাজীব খাদেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেবল দায়িত্ব পেয়েছি। এখন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। তবে প্রকল্পের ডিপিপি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে মেয়াদ বাড়াতেই হবে। মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। মেয়াদ একবছর বাড়ানোর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সম্মতি পাওয়া গেছে। তবে এখনো বাড়ানো হয়নি।’

ডিএসসিসি থেকে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার চারটি নেইবারহুড অর্থাৎ কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, নয়াবাজার-সূত্রাপুর-গুলিস্তান ও খিলগাঁও-বাসাবো-মুগদাকে চিহ্নিত করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নগরবাসীর জীবনমান ও পরিষেবা উন্নয়নে রাস্তা-ঘাট, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার, মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সসহ (মহানগর নাট্যমঞ্চ) অন্য কাজ অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের ডিপিপির প্রাক্কলিত ব্যয় ৮৮০ কোটি ৪৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প ঋণ ৮৩৪ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ অর্থায়ন বিশ্বব্যাংকের। সরকারি তহবিল মাত্র ৪৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। মূল অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ জুলাই ২০১৯ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানায়, প্রকল্পের আওতায় খেলার মাঠ, পার্ক ও সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠোমা নির্মাণের কথা বলা হলেও অগ্রগতি কম। ঢাকার পিছিয়ে থাকা ওই চার এলাকায় তিনটি খেলার মাঠ, আটটি শৌচাগার, নয়টি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র এবং পথচারী ও যানচলাচলের জন্য দুটি করে সেতু নির্মাণের কথা। এছাড়া ২০টি পার্কের উন্নয়ন, বুড়িগঙ্গা নদীর প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার তীর উন্নয়ন, চার কিলোমিটার সরু রাস্তা, ৩৯ কিলোমিটার নর্দমার উন্নয়নসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে অনেকটা তাড়াহুড়া করেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। ফলে উন্নয়ন কাজের যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা ছিল মূলত অনুমানের ভিত্তিতে। উন্নয়ন কাজ কোথায় হবে, ব্যয় কত হবে, এসব নিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষকে দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা (সমীক্ষা) হয়নি। তাই মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

যেমন তিনটি মাঠ তৈরির কথা বলা হলেও সেগুলো কোথায় হবে, জমি অধিগ্রহণ করা লাগবে কি না, তাতে কত ব্যয় হবে- এসব নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই নেই। এমন পরিস্থিতিতে পুরো পরিকল্পনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ছাড়া তা বাস্তবায়নের উপায় নেই। এসব কারণেও ঢেলে সাজাতে হচ্ছে প্রকল্পটি।