করযোগ্য আয় না থাকলেও রিটার্ন জমায় ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা প্রস্তাব করা হয়েছিল চলতি অর্থবছরের বাজেটে। যদিও বিভিন্ন মহলের প্রবল সমালোচনার মুখে এ বিধান বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে সরকার। আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের বাজেটে ফের ন্যূনতম করের বিধান রাখা হতে পারে। তবে কোন আঙ্গিকে, কী উপায়ে ন্যূনতম কর রাখা হবে তা চূড়ান্ত করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

আইএমএফের শর্ত ও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় অনেকখাত থেকেই উঠতে পারে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা। পাশাপাশি পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা ও এইচএস কোডের (হারমোনাইজড সিস্টেম) ভুলের শাস্তি দেওয়ার কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে সরকার।

সাধারণত কর ও শুল্ক অব্যাহতির তথ্য পাওয়া গেলেও ভ্যাট অব্যাহতির ফলে কী পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ এ বিষয়ে সঠিক তথ্য মেলে না। আসন্ন অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টি উঠে আসতে পারে। ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির পরিমাণ নিরূপণ করে বাজেট বক্তৃতায় তা তুলে ধরা হতে পারে। পাশাপাশি দেশে মেগা শিল্পের বিকাশ এবং আমদানির বিকল্প হিসেবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় শুল্ক ও ভ্যাটে দেওয়া হতে পারে বিশেষ সুবিধা।

এনবিআরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

আইএমএফের শর্ত ও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় অনেকখাত থেকেই উঠতে পারে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা। পাশাপাশি পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা ও এইচএস কোডের ভুলের শাস্তি দেওয়ার কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে সরকার।

গত (২০২৩-২৪) অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে সরকারি-বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন জমার স্লিপ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়, আয় না থাকলেও কোনো টিআইএনধারী ব্যক্তিকে আয়কর সনদ নিতে হলে ২ হাজার টাকা ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে। সরকারি ৪৪ ধরনের সেবা নিতে হলে এই আয়কর সনদ জমা বাধ্যতামূলক।

তবে মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে গতবার ন্যূনতম কর আরোপের বিধান থেকে সরে আসে এনবিআর। আগামী বাজেটে ফের ন্যূনতম কর রাখার বিষয় আলোচনায় আছে বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে কথা হয় এনবিআরের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এ কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতবার ন্যূনতম কর নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। সবাইকে ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে- বিষয়টি এমন ছিল না। গতবারের ভুল বোঝাবুঝি থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। আগামী বাজেটে ন্যূনতম কর বসানোর বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে কোন আঙ্গিকে করা হবে তা চূড়ান্ত হয়নি।’

ন্যূনতম কর বসানোর যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যেসব দেশের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতা করছি তাদের তুলনায় আমাদের দেশের করদাতারা অনেক কম কর দেন। এভাবে একটা দেশ চলবে কী করে?’

বর্তমানে কারও বার্ষিক আয় সাড়ে ৩ লাখ টাকা হলে তাকে কোনো আয়কর দিতে হয় না। তবে কারও বার্ষিক আয় সাড়ে ৩ লাখ টাকার বেশি হলে তার আয় করযোগ্য। সাড়ে ৩ লাখ টাকার পরবর্তী এক লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ আয়কর দিতে হয়। পরবর্তী ৩ লাখ টাকায় ১০ শতাংশ, এর পরের ৪ লাখ টাকায় ১৫ শতাংশ এবং পরবর্তী ৫ লাখ টাকার ওপর ২০ শতাংশ আয়কর দিতে হয় করদাতাকে। কারও বার্ষিক আয় এর বেশি হলে বাকি আয়ের ওপর তাকে ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়।

মেট্রোরেলে চড়তে ১ জুলাই থেকে ভ্যাট দিতে হবে
মামলায় আটকা ২৪৬৪১ কোটি টাকার ভ্যাট, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনিশ্চয়তা
৯ মাসে রাজস্ব ঘাটতি সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকা
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় অর্থনীতি যে খুব ভালো হয়েছে সেটা বলা যাবে না। অর্থনীতি সার্বিক ধারায় ফেরেনি। এমন অবস্থায় ন্যূনতম কর বসানোর প্রস্তাব খুব বেশি সুখকর হবে না।’

করজাল বাড়াতে উপজেলা পর্যায়ে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন উপজেলা পর্যায়েও অনেকের অবস্থা ভালো। তাদের ওপর যদি কর বসানো যায় তাহলে সরকার আরও বেশি রাজস্ব পাবে।’

সূত্র জানায়, পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতে করছাড় প্রত্যাহারে কাজ করছে এনবিআর। পাশাপাশি ২৭ ধরনের ডিজিটাল পরিষেবা খাতে কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছর। তথ্যপ্রযুক্তিতে কর অব্যাহতির মেয়াদ আর বাড়াতে চায় না এনবিআর।

এ দুই খাতের বিষয়ে এনবিআরের এক কর্মকর্তার বলেন, ‘কর ছাড়ের উদ্দেশ্য হলো দেশীয় শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে সহায়তা করা। মাছ, হাঁস ও মুরগি আমদানি হয় না। এখানে বিদেশি উৎপাদকদের সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশ এখন অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তার দাবি, এ দুই খাতের জন্য কর ছাড়ের কোনো প্রয়োজন নেই। বরং করছাড় প্রত্যাহার করা হলে স্থানীয় শিল্পগুলো নিজেদের মানের উন্নয়ন ঘটাতে বাধ্য হবে।

আগের ‘শিক্ষা’ কাজে লাগিয়ে ন্যূনতম করারোপের চিন্তাজাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন/ ফাইল ছবি

জানতে চাইলে বেসিস সভাপতি রাসলে টি আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি খাত যদি করের আওতায় আনা হয়, সেটা মোট রাজস্ব আয়ের ১ শতাংশও হবে না। এ খাত সবেমাত্র দাঁড়াতে শুরু করেছে। একটা সম্ভাবনাময় খাত হুমকির মুখে ফেলা ঠিক হবে না। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ খাতে কর অব্যাহতি বজায় রাখা আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

মেট্রোরেলের টিকিটসহ একাধিক খাতে ভ্যাট সুবিধা অব্যাহতি প্রত্যাহার করতে চায় এনবিআর। পাশাপাশি সব খাতের জন্য ইউনিফায়েড ভ্যাট বা একইহারে ভ্যাট প্রবর্তন করতে চায় সংস্থাটি। এছাড়া রিসাইকেল শিল্প বা পাটের তৈরি পণ্যে ভ্যাট সুবিধা দিতে নেওয়া হতে পারে পদক্ষেপ।

এসব বিষয়ে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাছ, মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে আমরা ভ্যাট নেই না। এই ভর্তুকির পরিমাণ কত- সেটা এবারের বাজেট বক্তৃতায় থাকবে। ইএফডির মাধ্যমে আমরা ভ্যাটের আওতা বাড়াতে কাজ করছি। তবে আইএমএফের শর্তের কারণে কিছু খাত থেকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হবে।’

মিস ডিক্লারেশন বা মিথ্যা তথ্যে পণ্য আমদানিতে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানার বিধান থেকে সরে আসার কথা ভাবছে এনবিআর। জরিমানা কমানোর বিষয়ে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি আগামী অর্থবছরের বাজেটে সুরাহা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের প্রাক বাজেট আলোচনায়ও ব্যবসায়ীরা এ দাবি জানান।

বড় কোম্পানির রিটার্ন অনলাইনে জমা বাধ্যতামূলক চায় আইএমএফ
ই-সিমসহ সব সিমে ভ্যাট প্রত্যাহার চায় অ্যামটব
সোনা পরিশোধনাগার শিল্পে ১০ বছর কর অবকাশ চায় বাজুস
এ বিষয়ে শুল্ক বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জরিমানার শাস্তি কমাতে চাপ আছে। তবে এনবিআর এখনই শাস্তি কমানোর বিপক্ষে।’

যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, ‘মিথ্যা তথ্যে পণ্য আমদানি ও বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের বিষয়ে আমাদের কাছে এভিডেন্স বেজড প্রমাণ রয়েছে। বেশিরভাগ বড় ব্যবসায়ী ১০টির মধ্যে ৮টি মিথ্যা ঘোষণায় আনতে চান। এছাড়া রাজস্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হয়রানির যেসব অভিযোগ আনা হয় সেটাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। (শাস্তির বিধান থাকলে) অসাধু ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়বেন, এটাই তো হওয়া উচিত।’

মেট্রোরেলের টিকিটসহ একাধিক খাতে ভ্যাট সুবিধা অব্যাহতি প্রত্যাহার করতে চায় এনবিআর। পাশাপাশি সব খাতের জন্য ইউনিফায়েড ভ্যাট বা একইহারে ভ্যাট প্রবর্তন করতে চায় সংস্থাটি। এছাড়া রিসাইকেল শিল্প বা পাটের তৈরি পণ্যে ভ্যাট সুবিধা দিতে নেওয়া হতে পারে পদক্ষেপ।

এইচএস কোডে ভুলের জরিমানা কমানোর প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘এখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি। এখানে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।’

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবারের মতো এবারও দেশীয় শিল্পকে এগিয়ে নিতে ও সুরক্ষা দিতে নানান উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। কোনো পণ্য আমদানিতে শুল্ক, অগ্রিম আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক ও নিয়ন্ত্রক শুল্ক আরোপ করা হয়। আগামী বাজেটে আমদানির ক্ষেত্রে এ হার বাড়ানোর বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। নতুন বাজেটে বিলাসবহুল পণ্যের আমদানির ওপর আরও বেশি শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। এছাড়া উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়- দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য করপোরেট করহার ২ দশমিক ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ফলে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে এই হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য করপোরেট করহার ২৫ শতাংশে নেমে আসবে। তবে ব্যাংক ও মোবাইলফোন অপারেটরদের ক্ষেত্রে করপোরেট করহার অপরিবর্তিত থাকবে বলে জানা গেছে। এ উদ্যোগের ফলে তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করতে চায় এনবিআর। আয়কর আইন ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ভালো বলেও মনে করছেন তারা।

এসব বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘সমাজে অসমতা বাড়ছে। ভ্যাটের যে ধারণা সেখানে সংস্কার প্রয়োজন। অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট কমাতে হবে। পাশাপাশি পরোক্ষ করের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে।’