গলিতে বাস আর প্রধান সড়কে রিকশা এখন রাজধানীর নিয়মিত দৃশ্য। মোটর সাইকেল চালক থেকে শুরু করে ব্যাটারি চালিত রিকশা-ভ্যান এমনকি বিলাসবহুল ব্যক্তিগত গাড়িচালক সবাই নিয়ম না মেনেই যত্রযত্র চলছে। দিন যত যাচ্ছে, রাজধানীর সড়কের বিশৃঙ্খলা যেন ততই বাড়ছে। ফলে সড়কে তীব্র যানজটের সঙ্গে বেড়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও।
ট্রাফিকের দায়িত্বরতরা বলছেন, সড়কে ন্যূন্যতম ট্রাফিক আইনও মানছে না অনেকেই। বিশেষ করে বাইকার ও ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। এদিকে প্রধান সড়কে দিনের বেশিরভাগ সময় যানবাহনের চাপ না থাকলেও বাসচালকদের বিশৃঙ্খল আচরণে স্টপেজগুলোতে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ জটলা। দেখা গেছে, মাত্র ২-৩টি বাস দাঁড়িয়ে থাকার কারণে সিগন্যাল পয়েন্ট ছাড়াই বিভিন্ন স্থানে জ্যামে আটকে থাকতে হচ্ছে দীর্ঘ সময়।
অন্যদিকে, রাজধানীর অলিগলির অবস্থা আরও খারাপ। সরেজমিন মিরপুর-মোহাম্মাদপুর থেকে শুরু করে ধানমন্ডি-বসিলা অন্যদিকে বাড্ডা-রামপুরা, মালিবাগ, বাসাবো, পল্টন, মতিঝিল, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, পান্থপথ কলাবাগান, ইস্কাটন, এলিফ্যান্ট রোড থেকে মতিঝিল সবখানেই ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজত্ব। দিনের বিভিন্ন সময় অনেক অলিগলিতে পা ফেলার জায়গা পায় না নগরবাসী।
এলাকাবাসী বলছেন, আগে সকালে অফিস ও স্কুল টাইমে রিকশা-গাড়ির চাপ দেখা যেত। কিন্তু এখন বিকাল থেকে বিশেষ করে সন্ধ্যার পর ৩-৪ ঘণ্টা রাস্তায় হাঁটার মতো পরিস্থিতি থাকে না। কারণ, এই সময় দল বেঁধে অটোরিকশা নিয়ে সড়কে নেমে পড়ে চালকরা। জানা গেছে, এসব চালকের অনেকই রিকশাচালক নন। মাত্র ২-৩ ঘণ্টা করে তারা রিকশা চালান। কেউ কেউ একবার চার্জ দিয়ে যতক্ষণ চালানো যায়. ততটুকু সময় চালান।
সরেজমিন রোববার সন্ধ্যায় মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকা ও শ্যামলী থেকে রিংরোড হয়ে মোহাম্মদপুর ও সাত মসজিদ রোডের অন্তত ৫০ শতাংশই ছিল অটোরিকশা দখলে। যার মধ্যে যাত্রী নেই বেশির ভাগ রিকশায়। এসব চালকরাই বলছেন সন্ধ্যায় যাত্রীর চেয়ে রিকশা বেশি থাকে, তাই অনেকেই খালি বসে থাকেন।
রিং রোডের স্থায়ী বাসিন্দা মিরাজ চৌধুরী বলেন, কিছু দিন আগেও তাজমহল রোড, জাপান গার্ডেন ও কৃষি মার্কেটের সামনে কিছু যানজট থাকলেও অলিগলিতে তেমন গাড়ি দেখা যেত না। কিন্তু আটোরিকশা চালানোর অনুমতি পাওয়ার পর গোটা মোহাম্মাদপুর ও রিং-রোড সংলগ্ন সড়কগুলো সন্ধ্যায় দীর্ঘ যানজট দেখা যাচ্ছে। যা গত দুই মাসে আরও কয়েক গুণ বেড়েছে।
কথা হয় আটোরিকশা চালক শাহজালালের সঙ্গে। আগে কৃষি মার্কেটে চালের আড়তে কাজ করলেও এখন একবেলা রিকশা চালান, মাঝে মাঝে প্রয়োজন পড়লে আড়তে কাজ করেন। শাহজালাল বলেন, দিনে অনেক রোদ ও গরম থাকে, তাই আমার মতো বেশিরভাগ চালকই রাতে ২-৩ ঘণ্টা গড়ে রিকশা চালান, এতেই ৫০০-১০০০ টাকা আয় হয়।
শাহজালালের মতো অসংখ্য রিকশাচালক যারা অন্য পেশা থেকে এসে এখন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগেরই সড়কের আইন অর্থাৎ ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জানেন না। উল্টো রাস্তায় চলার পাশাপাশি কোনো ধরনের সিগন্যাল ছাড়াই, হুটহাট লেন পরিবর্তন করে ফেলেন। ফলে দ্রুতগামী পরিবহনগুলোর সঙ্গে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
এদিকে এসব অটোরিকশা ঘন্টায় প্রায় ৪০ কিলোমিটার বেগে চলতে সক্ষম। কিন্তু এসব রিকশার সাসপেনশন, ব্রেকিং সিস্টেম সর্বোচ্চ ১৫ কিলোমিটার বেগ নিয়ে চলতে পারে। ফলে ইমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে এসব রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না চালকরা। এ ছাড়াও কোনো ধরনের সিগন্যাল বাতি ও লুকিং গ্লাস না থাকায় চালক তার চারপাশে বা পেছনে কোনো গাড়ি আছে কিনা, তাও দেখতে পায় না। কেবল মাত্র অনুমান ও শব্দ শুনে চলতে যা যাত্রী ও চালকের জন্য দুর্ঘটনার ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর সড়কে আয়তনের অনুপাতে যানবাহনের পরিমাণ এমনিতেই অনেক বেশি, তাই বিভিন্ন সিগন্যালে লম্বা যানজট লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বর্তমানে এর মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা। ফলে সড়কে ফাঁকা স্থানের পরিমাণ কমে গেছে।
মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার রিকশাচালকরা জানান, প্রতিদিন বিকালে মিরপুর এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়কে বের হয়। একইভাবে মোহাম্মাদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় আরও ২০ হাজার রিকশা সড়কে চলে। ফলে তীব্র যানজট ও জনভোগান্তি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
এসব রিকশায় কোনো অনুমোদন প্রয়োজন হয় না। ফলে প্রতিদিন রাজধানীতে কি পরিমাণ অটোরিকশা চলে, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। এ ছাড়াও পায়ে চালিত রিকশাকে অনেকেই ব্যাটারি লাগিয়ে আটোরিকশায় কনভার্ট করেছেন। ফলে এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
এদিকে ৫ আগস্টের সরকার পতনের পর সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পুরো পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। যদিও গত এক মাস ধরে ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি ও কর্মতৎপরতা বেড়েছে। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক ও সিগন্যালগুলোতে পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে তাদের উপস্থিতি খুবই কম।
অন্যদিকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে অনেক রাস্তাই বন্ধ করে দিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। যেমন তেজগাঁও এলাকায় বিজয় সরণি ফ্লাইওভার থেকে আসা যানবাহনগুলো কেবল মগবাজার ও মাহাখালীর দিকে যেতে পারে। অন্যদিকে মহাখালী থেকে মগবাজার যেতে হলে যানবাহনগুলোকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। মূল উল্টো পথে যানবাহন চলাচল রোধ করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেখানে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ট্রাফিক পুলিশ আইনের প্রয়োগ করতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে এসব সড়ক বন্ধ করে দিয়ে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করছেন। তবে ট্রাফিক বিভাগ তাদের কর্মতৎপরতা কিছুটা বাড়িয়েছেন। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ৩১ অক্টোবর ও ১ নভেম্বরÑ এই দুই দিনে ২৫২৭টি মামলা করা হয়েছে। এ সংক্রান্তে ৯২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, গত দুই দিনে ২৫২৭টি মামলা ও ৯২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ সময় অভিযানকালে ১৬৬টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৭১টি গাড়ি রেকার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর এলাকায় ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষায় ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।